Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

নেপোলিয়নকে কি অর্থে এবং কতদূর পর্যন্ত বিপ্লবের সন্তান বলে বর্ণনা করা যায়?

ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপের বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত চরিত্র নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তাঁর বহুমুখী চরিত্রের এবং সমকালীন পরিস্থিতির দ্বারা গভীরভাবে আলোড়িত জীবনের মূল্যায়নে তর্কাতীত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজসাধ্য নয়। সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা এনেছে তাঁরই দুটি পরস্পরবিরোধী উক্তি। সেণ্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে বসে নেপোলিয়ন যে আত্মজীবনী রচনা করেন, তাকে ‘নেপোলিয়ন উপাখ্যান’ বা ‘লিজেণ্ড’ বলা হয়। এই গ্রন্থেই তিনি দুটি উক্তি করেন— “আমিই বিপ্লব” এবং “আমিই বিপ্লব ধ্বংস করেছি।” আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী এই দুটি উক্তি ঝড় তুলেছে ঐতিহাসিক মহলে।

নেপোলিয়নের উপরিলিখিত দুটি উক্তি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী হলেও গভীর পর্যালোচনায় অনুভূত হয় দুটি উক্তিই সত্য। এই সত্যতা জানার জন্য দেখা দরকার বিপ্লব ও নেপোলিয়ন আদর্শগত ভাবে কতখানি একতাবদ্ধতা এবং কি অর্থে তিনি সেই বিপ্লবকে ধ্বংস করেছিলেন।

বিপ্লবের লক্ষ্য আদর্শ

ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সর্বসাধারণের ভোটের ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছিল বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফল। এই গণতন্ত্র বা নাগরিক স্বাধীনতা স্বৈরতন্ত্রকে লোপ করে প্রতিষ্ঠা করে বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা, বৃদ্ধি করে প্রাদেশিক সভার সংখ্যা, নগর-কমিউন প্রভৃতির ক্ষমতা। প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের শাসন। আইনের নিকট সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্থাপিত হয়। বিলোপ করা হয় সামন্ত-প্রথার। লুপ্ত হয় সামন্ত-প্রভুদের বিশেষ অধিকার। স্থাপিত হয় সামাজিক সমতা। অর্থাৎ স্বাধীনতা এবং সাম্য, — এই দুটিই ছিল ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ এবং লক্ষ্য।

বিপ্লবী আদর্শের সাথে মিল

(১) নেপোলিয়ন ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ সাম্যকে গ্রহণ, রক্ষণ এবং পরিবর্ধন করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তিনি নিজেই ছিলেন সাম্যের প্রতিভু। রাজরক্তের গরিমা বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতা কিছুই তাঁর ছিল না। তবুও তিনি ফরাসীদের সম্রাট হতে পেরেছিলেন এবং তা যথেষ্ট সমাদরের সাথেই। বিপ্লব ব্যতীত তাঁর এই উত্তরণ সম্ভব হোত কিনা সন্দেহ আছে।

(২) শুধু অ-রাজবংশসম্ভূত নয়, অনেকের মতে তিনি বিদেশীও। ফরাসী নন, ইতালীয়। কিন্তু বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ‘সাম্য’ তাকে প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল জনগণের উদার মানসিকতা সৃষ্টি দ্বারা। তিনি বলতেন : “ফ্রান্সের জন্য যা জয় করা হচ্ছে তা আসলে জনগণের মুক্তির জয়।’ বিপ্লবের লক্ষ্য এবং নিজ ব্যক্তিত্বকে তিনি অভিন্ন করে তুলেছিলেন। তাই ‘নেপোলিয়ন বিপ্লবের সন্তান’—এ মত সত্য।

(৩) বিপ্লবের সন্তান, বিপ্লবের ধারক এবং বাহকও ছিলেন নেপোলিয়ন। তিনি বলেছিলেন, ‘What the nation wants is not liberty but equality.’ তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে এই বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ১৭৯১ থেকে ১৭৯৪ খ্রীঃ পর্যন্ত বিপ্লবী শাসনের দ্বারা সামন্ত-প্রথা, সামন্ত-কর, স্থানীয় শুল্ক প্রভৃতি অধিকারসমূহ লোপ করা হয়েছিল। নেপোলিয়ন ঐসব বিপ্লবী আদেশ বহাল রাখেন।

(৪) বিপ্লবী আমলে ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরি ও অন্যান্য সুযোগের যে নিয়ম প্রচলিত ছিল, নেপোলিয়ন সেগুলিকেও মর্যাদার সাথে বহাল খেন। বিপ্লবী যুগের ভূমিব্যবস্থাও তিনি অপরিবর্তিত রাখেন।

(৫) ‘কোড্ নেপোলিয়ন’ দ্বারা তিনি আইনের চক্ষে সকলের সমান অধিকার স্থাপন এবং প্রতিষ্ঠা করেন সামাজিক সাম্য।

(৬) ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শকেও তিনি রক্ষা করেন।

(৭) এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিবর্গ কর্তৃক বিপ্লবী ফ্রান্স বারবার আক্রান্ত হলে, নেপোলিয়নই নিজ অসীম ক্ষমতা ও ধৈর্য দ্বারা দেশকে রক্ষা করেন এবং বিপ্লবকে স্থায়িত্ব দান করেন। এর ফলে বিপ্লবের ভাবধারা কালক্রমে ইউরোপের অন্যান্য বহু দেশে বিস্তৃতি লাভে সক্ষম হয়। তাই ফিলিপ গডেলারের মতে, “The Nepoleonic Empire was not an interruption but an extention of the Revolution.’ অতএব নেপোলিয়ন নিজেকে বিপ্লবী বলে যে দাবি করেন, তা একেবারেই অযৌক্তিক, — একথা বলা যায় না। এই বিবেচনায় তাঁকে ‘Heir and Executor of the Revolution’ একথা বলা যায়।

বিপ্লবী আদর্শের সাথে বিরোধ

থমসন-গ্যারাট প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, নেপোলিয়ন অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লবের আদর্শকে লঙ্ঘন করেছেন। তাঁদের ভাষায় : “Nepoleon was the child of the Revolution, but in many ways he reversed the aims adn principles of the movement from which he sprang.” বাস্তবক্ষেত্রে নেপোলিয়নের বেশকিছু কাজ প্রমাণ করে তিনি সত্যই বিপ্লবের ধ্বংসকারী।

(১) বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ গণতন্ত্র বা স্বাধীনতার প্রতি নেপোলিয়নের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। তিনি কন্সুলেট দ্বারা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পুনঃসথাপন করেন। তিনি প্রথম কন্সালরূপে নিজহাতেই রাখেন সর্বময় কর্তৃত্ব। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্‌সাল ছিল নেপোলিয়নের আজ্ঞাবাহী কর্মচারী মাত্র।

(২) এমনকি গণতন্ত্রের কাঠামোস্বরূপ যে চার কক্ষযুক্ত আইনসভা ছিল, তাও ছিল প্রহসন মাত্র। কারণ সভাগুলির ক্ষমতা এমন চতুরভাবে বিভাজন করা হয়েছিল যে, প্রকৃত অর্থে কারো হাতেই কোন কার্যকরী ক্ষমতা ছিল না। এমনকি নেপোলিয়ন প্রাদেশিক সভাগুলির ক্ষমতাও বহুল পরিমাণে হ্রাস করেন।

(৩) তিনি সরকারী কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন-প্রথার পরিবর্তে মনোনয়-প্রথা প্রবর্তন করে একনায়কতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করেন। ১৮০৪ খ্রীঃ কন্সুলেটের সংবিধান লোপ করে তিনি সম্রাট-পদ গ্রহণ করলে প্রজাতন্ত্রের মুখোশটুকুও খসে পড়ে। ফরাসীজাতির হতাশাবোধ নেপোলিয়নকে এই অসাধ্য সাধনে সাহায্য করে। “বিপ্লবের আশাবাদ শেষ পর্যন্ত হতাশায় পরিণত হয়ে নেপোলিয়নের পদতলে পতিত হয়।”

(৪) অনেকের মতে, তিনি ‘সাম্য’কেও পূর্ণ মর্যাদা দেননি। কারণ তিনি দরিদ্র মানুষের স্বার্থে প্রণীত Law of maximum এবং Law of minimum কেও পুনঃপ্রবর্তন করেননি।

(৫) নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের মাধ্যমে ইউরোপে বিপ্লবের আদর্শ বিস্তার লাভ করেছিল,—এ ধারণাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ তাঁর সাম্রাজ্য ছিল শোষণ ও স্বৈরাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। আসলে তিনি বিপ্লবকে নিজে প্রয়োজনমত ব্যবহার করেন। তাঁর নীতি বুর্জোয়াশ্রেণীকেই রক্ষা ও সমৃদ্ধ শালী করে তোলে, সাধারণ মানুষকে নয়। এমনকি সাধারণ মানুষের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও তিনি করেননি।

সিদ্ধান্ত

লেফেভর, মঁতিয়ে, গুডউইন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, ডাইরেক্টরীর শাসনকালই ছিল বিপ্লবের শেষ পর্যায়। এঁদের মতে, নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্রই বিপ্লবকে ধ্বংস করে। আসলে নেপোলিয়নের শাসনে একটা স্ববিরোধিতা ছিল যা ক্ষমতার উত্তরণের সময় তাঁর কার্যকলাপকে কিছুটা বৈপ্লবিক আদর্শের সমার্থক করে তুলেছিল।

প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন বিপ্লব-বিরোধী। এই অনুভূতি তাঁর মধ্যেও এসেছিল। তাই নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘আমি বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি’ বলে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে নেপোলিয়নকে ‘বিপ্লবের সন্তান’ বলা যায় না।

Leave a reply