Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের কারণ

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একজন সামান্য গোলন্দাজ রূপে জীবন শুরু করে ফ্রান্সের সম্রাট-পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, কি বিরাট দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব তাঁর ছিল। শুধু ফরাসী-সম্রাট নন, তিনি নিজ-বাহুবলে ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলের উপরে নিজ-কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। ১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন নেপোলিয়ন। কিন্তু একসময় সেই বিরাট ক্ষমতাবান মহানায়কেরও পতন শুরু হয় এবং রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। নেপোলিয়নের এই পতন কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না।

আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধে পরাজয় তাঁর পতন সূচনা করলেও, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও বৈচিত্র্যময় বহু কারণ, – যা তাঁর পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

(১) সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা

সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অত্যধিক আত্মপ্রত্যয় নেপোলিয়নকে ক্রমশ পতনের দিকে নিয়ে যায়। প্রথমদিকের নিরবচ্ছিন্ন সাফল্য তাঁর আত্মবিশ্বাসকে এত বেশী আচ্ছন্ন করেছিল যে, ‘মধ্যপন্থী সতর্কতা’ কথাটি তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তাঁর সদম্ভ উক্তি ‘অসম্ভব কথাটি কেবল মূর্খের অভিধানে থাকে’ প্রমাণ করে তাঁর আত্মপ্রত্যয় কোন্ স্তরে পৌঁছেছিল। মার্শাল ফাশের ভাষায় : “তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, মানুষ ঈশ্বর নয় এবং ব্যক্তির উপর জাতি ও সমগ্র মনুষ্যজাতির উপর নৈতিক নিয়ম আছে। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ সর্বোচ্চ লক্ষ্য নয়, কারণ শান্তির শক্তি যুদ্ধের থেকেও বেশী।” এই দন্তই তাঁকে সৎপরামর্শদাতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। বস্তুত ‘তিনি পরামর্শদাতা চাননি,—ভৃত্য চেয়েছিলেন।” ফলে উপযুক্ত পরামর্শলাভের সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হন। তাঁর ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে তাঁলেরা, ফশো প্রমুখ তাঁকে ত্যাগ করে শত্রুশিবিরে যোগ দিতে বাধ্য হন।

(২) বহুজাতিক সেনাবাহিনী

বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত ফরাসী বাহিনীর সর্বোচ্চ দক্ষতার বিকাশ এবং নেপোলিয়নের অলৌকিক সামরিক প্রতিভা তাঁর সাফল্য এনে দিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই দুটি গুণেরই ঘাটতি দেখা দেয়। তাঁর ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্য ও ক্রমপ্রসারিত যুদ্ধের প্রয়োজনে ফরাসী বাহিনীকে বৃদ্ধি করেত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তিনি বিজিত দেশসমূহ থেকেও সৈন্য সংগ্রহ করেন। ফলে ফরাসী বহিনীর জাতীয় চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়। নানা জাতি নিয়ে গঠিত বাহিনীর কোনরকম আত্মত্যাগের প্রেরণা ছিল না। তা ছাড়া, ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে বাহিনী হয়ে পড়েছিল রণক্লান্ত। একই কারণে স্বয়ং নেপোলিয়নেরও পূর্বের মত উদ্যম ও চিন্তার প্রখরতা ছিল না। শেষের দিকে তিনি বারবারই যুদ্ধে কৌশলগত ভুল করতে থাকেন, যেমন রাশিয়াকে আক্রমণ করা।

(৩) ইংল্যান্ডের বিরোধিতা

ইংল্যাণ্ডের নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা নেপোলিয়নের পতনের জন্য খুব কম দায়ী ছিল না। ইংল্যান্ডের উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায় বারবার গঠিত হয়েছিল নেপোলিয়ন-বিরোধী ইউরোপীয় শক্তিজোট। পরপর চারটি শক্তিজোটের মোকাবিলা নেপোলিয়নকে করতে হয়েছিল। চতুর্থ শক্তিজোটে চারটি বহূৎ রাষ্ট্রকে একত্রিত করার কৃতিত্ব ইংল্যান্ডের প্রাপ্য। এককভাবে ইংল্যান্ডের নৌ-শক্তি ছিল সমগ্র ইউরোপীয় নৌ-বাহিনীর মিলিত শক্তির থেকেও বেশী। স্বভাবতই এমন শক্তিশালী। নৌ-বাহিনী বারবার নেপোলিয়নকে বিপর্যস্ত করতে থাকে। স্মরণ করা যেতে পারে নীলনদের যুদ্ধ-ট্রাফাল্গার এবং ওয়াটার্লুর যুদ্ধ, প্রতি ক্ষেত্রেই নেপোলিয়ন পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

(৪) মহাদেশীয় অবরোধের ব্যর্থতা

‘মহাদেশীয় অবরোধ’ ব্যবস্থার ব্যর্থতা নেপোলিয়নের পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বন্ধ করে নেপোলিয়ন বণিক ইংল্যান্ডের আর্থিক ভিত্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য যে মহাদেশীয় অবরোধ-ব্যবস্থা ঘোষণা করেন, তা বুমেরাং হয়ে ফ্রান্সেরই রাজনৈতিক মর্যাদা ও অর্থনীতিকে ধুলিসাৎ করে দেয়। এই ব্যবস্থার ব্যর্থতা রাজনৈতিকভাবে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন, এর জন্যই তিনি পর্তুগাল ও স্পেনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন; এর জন্যই তিনি রাশিয়া আক্রমণ করে মহা ভুল করেন। এমনকি মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার অবাস্তবতা ফরাসীবাসীকেও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী দুর্লভ ও দুর্মূল্য হওয়ার ফলে সারা ইউরোপ জুড়েই নেপোলিয়ন-বিরোধী হাওয়া বইতে শুরু করে।

(৫) রুশ-অভিযানের ব্যর্থতা

নেপোলিয়ন কর্তৃক রাশিয়াকে আক্রমণ তাঁর পতনের চূড়ান্ত পর্বের সূচনা করে। মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের অদূরদর্শিতার চরমতম বহিঃপ্রকাশ। কারণ রাশিয়া মিত্র থাকলে পশ্চিম রণাঙ্গনে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেত পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার দত্তে রাশিয়াকে আক্রমণ করে তিনি একই সাথে পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে তাঁর পরাজয় বরণের ইতিহাসও ছিল লজ্জাকর। তিনি রাশিয়ার কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে একপ্রকার বিনাযুদ্ধে বিরাট সৈন্যবাহিনী ও বিশাল অর্থ ধ্বংস করে আসেন। তাঁর ‘গ্রান্ড আমি’ একেবারেই ভেঙে যায়। এই পরাজয়ের গ্লানি স্বদেশে ও বিদেশে তাঁকে প্রায় ‘অতীত ব্যক্তিত্বের’ অধিকারী করে দেয়। অজেয় গ্রান্ড আর্মির এই ব্যর্থতা ‘মুক্তিযুদ্ধে’র পথ প্রশস্ত করে।

(৬) বিরোধী বাহিনীর দক্ষতা

নেপোলিয়নের বাহিনীর যে স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যুদ্ধকৌশল প্রথম দিকের যুদ্ধে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ডকে দমিয়ে রেখেছিল, পরের দিকে তা সম্ভব ছিল না। কারণ ফরাসী বাহিনীর সাথে নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে অন্যান্য দেশের বাহিনীও নেপোলিয়নের যুদ্ধকৌশলরপ্ত করে ফেলেছিল বা তাকে প্রতিহত করার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছিল।

(৭) স্ববিরোধী নীতি

নেপোলিয়নের স্ব-বিরোধী নীতিও তাঁর পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। ‘বিপ্লবের সন্তান’ হিসেবে তার উত্থান ঘটেছিল এবং তিনি বিজিত বিপ্লবের ভাবধারা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে বোনাপার্টীয় রাজবংশ রাজ্যসমূহে।

প্রতিষ্ঠার বাসনা ছিল সদাজাগ্রত। হল্যান্ড, স্পেন, ওয়েস্টফেলিয়া, নেপল্স প্রভৃতি একাধিক দেশে তিনি নিজ-রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, নেপল্স প্রভৃতি একাধিক দেশে তিনি নিজ সদাজাগ্রত। হল্যাণ্ড, স্পেন, ওয়েস্টফেলিয়া, নেপল্স প্রভৃতি একাধিক দেশে তিনি নিজ-রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু কোন দেশেই তার শেকড় মাটির গভীরে যেতে পারেনি। প্রাচীন রাজবংশীয় আধুনিক জাতীয়তাবাদী নীতির মধ্যে তিনি একটা সমন্বয়সাধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই দুই পরস্পরবিরোধী ভাবধারার মিলন ছিল এক অসম্ভব কাজ। এইসব দেশের কাউকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তিনি দেননি। এমনকি নিজের প্রয়োজনে ঐসব দেশ বা জাতিকে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। ফলে জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ঐসব জাতি তাদের স্রষ্টার বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারণ করেছিল। যে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নেপোলিয়নের পতনকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিল, তা তাঁর স্ববিরোধিতারই ফসল।

(৮) পোপের সাথে সংঘাত

পোপের সাথে সংঘাত নেপোলিয়নের পতনের জন্য অনেকটা দায়ী ছিল। এমনিতেই পোপের সাথে বিপ্লবের একটা সংঘাত ছিল ফলে বিরাটসংখ্যক যাজক ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকদের বিপ্লব-বিরোধী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম কন্সাল হিসেবে নেপোলিয়ন পোপের সাথে চুক্তি করে (১৮০১ খ্রীঃ) সেই ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করলেও, সম্রাট হিসেবে তিনি পোপের রাজ্য গ্রাস করলে এবং পোপকে বন্দী করে ইতালী থেকে ফ্রান্স আনলে অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ হয়। ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক সমাজ অনুভব করে নেপোলিয়ন ধর্মের শত্রু।

(৯) আইনগত সমর্থনের অভাব

সিংহাসনে নেপোলিয়নের কোনরূপ আইনগত অধিকার ছিল না। বংশ-মর্যাদার দিক থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণ। ফলে তাঁর সাম্রাজ্য নির্ভরশীল ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর। যে মুহূর্তে তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছি, সেই মুহূর্তে তাঁর সিংহাসন টলমল করে উঠেছে। এ সত্য তিনি নিজেও জানতেন। তাই একদা তিনি বলেছিলেন ‘বংশানুক্রমিক রাজার বিশ বার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও রাজনীতিতে বহাল থাকতে পারে; কিন্তু আমি ত পারি না; কারণ আমি ভুঁইফোড় সৈনিক। আমার শক্তি থাকবে না, আমাকে দেখে লোকে ভয় পাবে না—এমন দিন যদি কখনো আসে, সেদিনই আমার কৃর্তত্ব শেষ।’ বাস্তবে ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল।

(১০) ভ্রান্ত অর্থনীতি

ঐতিহাসিক টার্লে নেপোলিয়নের পতনের জন্য তাঁর ভ্রান্ত অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন। নেপোলিয়ন বিজিত দেশগুলির অর্থ-ব্যবস্থাকে ফ্রান্সের স্বার্থে নিয়োজিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বিজিত দেশসমূহের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রান্সের দ্রব্যের বাজার তৈরি করার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনড়। এই অর্থব্যবস্থা বিজিত দেশগুলিকে তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল। তাই টার্লে মনে করেন, স্পেন-যুদ্ধ বা রুশ-যুদ্ধ না-হলেও এই অর্থনৈতিক ভ্রান্তি নেপোলিয়নের পতন অনিবার্য করে তুলত। অবশ্য অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা টার্লের মত এই কারণকে এতটা গুরুত্ব দিতে চাননি।

এইভাবে নৈতিক, আর্থিক, সামরিক, মানসিক, শারীরিক, দার্শনিক ও কৌশলগত নানা ত্রুটির সমন্বয়ের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মত অভূতপূর্ব জনপ্রিয়, বন্দিত ও নিন্দিত রাজপুরুষের পতন ঘটেছিল।

Leave a reply