ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা
নারীর ভূমিকা যতটা না সক্রিয় ছিল, তার চেয়ে বেশি সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁরা। বিপ্লবীদের জন্য দান ও দেখাশোনা করা, সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলার নারী সমাজ স্বদেশি আন্দোলনের বৃহৎ কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাগজের প্রচলন, মদের দোকান পিকেটিং ইত্যাদি কর্মসুচিতেও নারীরা যোগ দিয়েছিলেন। স্বদেশি আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলা নারীরা মূলত সহযোগির ভূমিকা গ্রহণ করলেও কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত থেকে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে যে নামটি সর্বপ্রথম উল্লেখের দাবি রাখে তা হল সরলা দেবী চৌধুরীর নাম। স্বর্ণকুমারীর কন্যা, রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলা দেবী চৌধুরাণি ১৯০১-এর কংগ্রেস অধিবেশনে গান গেয়ে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর গান সেই সভায় উপস্থিত সদস্যদের দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছিল। দেশের যুবশক্তিকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য ভূমিকা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের যুব সমাজের স্বাস্থ্যর উন্নতি না ঘটলে জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাই তিনি আখড়া বা ব্যায়াম সমিতি গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯০২-০৩ সাল নাগাদ সরলাদেবী বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতিপাদিত্য ব্রত, উদয়াদিত্য ব্রত ইত্যাদি সংগঠিত করেন। এই উৎসবগুলিতে বাঙালি যুবকদের লাঠিখেলা, তরবারি খেলা, কুস্তি প্রদর্শনী, শরীরচর্চা এই সব কিছু চলত।
কার্জনের বঙ্গ বিভাজনের পরিকল্পনা শিক্ষিত হিন্দু বাঙালির কাছে ছিল বহিরাগত শত্রুর হাতে লাঞ্ছনা। প্রকাশিত হল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’। বলা হল বাংলার লক্ষ্মী মেয়েরাই বাংলার লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনতে পারেন। হিন্দু-মুসলমান মৈত্রী বন্ধন এবং বিদেশী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে। “মা লক্ষ্মী কৃপা কর। কাঞ্চন দিয়ে কাঁচ তেনব না। শাঁখা থাকতে চুড়ি পরব না। ঘরের থাকতে পরের নেব না। পরের দুয়ারে ভিক্ষা করব না। মোটা অন্ন অক্ষয় হোক। মোটা মন্ত্র অক্ষয় হোক। ঘরের লক্ষ্মী ঘরে থাকুক।” সহজ ভাষায় সরল আবেদন বাংলার মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কারণ কবি মুকুন্দ দাস তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্চকিত ভঙ্গিতে বঙ্গনারীকে রেশমি চুড়ি ছেড়ে দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এই সমস্ত আবেদন নিস্ফল হয়নি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের নারীদের অংশগ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিনটিতে অর্থাৎ ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর কলকাতার নারী সমাজের একটা বড়ো অংশ অরন্ধন পালন করে, উপবাস করে চরকা কেটে দিনটি অতিবাহিত করেছিলেন। ফেডারেশন হলের ভিত্তি স্থাপনের দিন ৫০০ মহিলার জমায়েত হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের জেমোকান্দি গ্রামে ৫০০-রও বেশি মহিলা রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর বিষ্ণুপ্রাঙ্গণে বসে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র ব্রতকথা শুনেছিলেন। সেই ব্রতকথা পাঠ করেছিলেন রামেন্দ্র কন্যা গিরিজাসুন্দরী। পাঠ শেষে উপস্থিত পুরনারীরা সমবেতভাবে বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের শপথ নিয়েছিলেন। বরিশালের ১৩ বছরের গৃহবধূ মনোরমা বসু সদর রাস্তায় এক নারীবাহিনী সংগঠিত করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। খুলনার লাবণ্য প্রভা দত্ত স্বদেশি মনোভাবাপন্ন হয়ে কেবলমাত্র স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করার ব্রত নিয়েছিলেন। তাঁর স্বদেশিকতার প্রভাবে পরিবারের অন্যান্যরাও স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় মোটামুটি সেই সময় বা তারপর থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে হোমরুল আন্দোলন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে, কেবলমাত্র উচ্চবর্গীয় এলিট গোষ্ঠীভুক্ত মহিলারাই হোমরুল লিগের সংস্পর্শে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে দুই বিখ্যাত নারী ভারতীয় রাজনীতিতে অসামান্য প্রভাব ফেলেছিলেন। একজন অবশ্যই অ্যানি বেসান্ত অন্যজন সরোজিনী নাইডু। হোমরুল আন্দোলনের নেত্রী অ্যানি বেসান্ত ১৯১৭ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। এই একই বছর সরোজনী নাইডু লন্ডনে একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে ভারত সচিব মন্টেণ্ডর সঙ্গে দেখা করে নারীর ভোটাধিকার দাবি করেন। ১৯১৭ সালের নারী সংগঠন হিসাবে Womens India Association আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৮ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে এই প্রথম নারীদের বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়। নারী ও পুরুষ সকলের জন্য সমান ভোটাধিকার দাবি করে কংগ্রেস অধিবেশনে প্রস্তাব দেন সরোজনী নাইডু। এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯২৫ সালে সরোজিনী নাইডু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত করেছিলেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .