Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা কর।

সূচনা : ফরাসি বিপ্লবের কারণ সম্বন্ধে আধুনিককালে ঐতিহাসিকরা অনেক নতুন তথ্যের অনুসন্ধান করেছেন। অর্থনৈতিক সামাজিক কারণগুলি তাঁরা যেমন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেছেন; তেমনি বিপ্লবের কারণ হিসেবে দার্শনিকদের অবদানকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে আগে যেমন আর্থিক কারণগুলির উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হতাে ইদানীং সামাজিক কারণগুলির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আধুনিককালের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে ফ্রান্সের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করা যুক্তি সংগত।

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা 

ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের সমাজ-ব্যবস্থায় প্রচুর গলদ ছিল। চতুর্দশ লুই ও তার মন্ত্রীরা ফ্রান্সে এমন এক সমাজ ও রাজনৈতিক প্রথা গড়ে তােলেন, যখন ইংল্যাণ্ডে মানব-সমাজের ভালভাবে অগ্রগতি ঘটেছিল। চতুর্দশ লুই-এর আমলে ফরাসি সমাজের রূপ অনেকটা পিরামিডের ন্যায় ছিল— সর্বনিম্নে কৃষক, ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবিরা। তাদের দেয় ট্যাক্সেই সরকারের আর্থিক সংগতি নির্ভর করতাে এবং তারাই সমাজের আর্থিক বুনিয়াদ গঠনের দায়িত্ব নিয়েছিল। এর বদলে তারা রাজার কাছ থেকে আশা করতাে যে তাদের প্রাচীন অধিকারসমূহ রক্ষা করা হবে। ফলে কৃষকদের মধ্যে অনেকেই ভূমির মালিক হতে পেরেছিল। শহরে শহরে বহু গিল্ড বা বাণিজ্য সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

কালক্রমে অভিজাত শ্রেণিও ফ্রান্সে সুবিধাভােগী শ্রেণিতে পরিণত হয়। কারণ রাজা। ব্যবসায়ীদের অভিজাত অভিজাত শ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রক্ষা করতেন। অভিজাত শ্রেণির কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতাে না, কেউ করলে তাকে শ্রেণিচ্যুত করা হতাে এবং সে আর অভিজাত বলে গণ্য হতাে না।

সুবিধাভােগী সম্প্রদায় : দেশের শাসনভার ন্যস্ত ছিল রাজার সৃষ্ট একটি বিশেষ দলের হাতে। আর যারা অভিজাত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের শাসনকার্যে কোন ক্ষমতা না থাকলেও তারা কয়েকটি সুবিধা ভােগ করতাে, যেমনড কর দিতে হতাে না। সৈন্যবাহিনীতে অফিসার তাদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হতাে এবং বিচারালয়ের বিচারক। তাদের মধ্যে থেকেই নেওয়া হতাে। এর উপর ভিত্তি করেই প্রাচীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন ফ্রান্সের সামাজিক ব্যবস্থা একটু পরীক্ষা করলেই বােঝা যাবে যে বাস্তব অবস্থা থেকে এটা কতদূরে ছিল।

সামাজিক অসাম্য ঃ প্রথমত ফরাসি সমাজ পাঁচভাগে বিভক্ত ছিল – অভিজাতশ্রেণি, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারি, যাজকবৃন্দ, মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং কৃষক সম্প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে ফরাসি সমাজ কিন্তু এত সহজ সরল ছিল না, বিশেষ জটিল আকার ধারণ করেছিল। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির মধ্যেই শ্রেণিসংঘাত দেখা দেয়। ফলে প্রত্যেক শ্রেণি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাজকরা সবাই সমান ছিলেন না। সুতরাং ফরাসি সমাজে অসাম্যের অন্ত ছিল না।

যাজক শ্রেণির মধ্যে উচ্চতর সম্প্রদায় বহু সুবিধা ভােগ করত কিন্তু ধর্মপ্রচার বা জনসাধারণের নৈতিক উন্নতির জন্য কিছুই করত না, বর ধর্মীয় কাজের পরিবর্তে তারা। আমােদ-প্রমােদে দিন কাটাত। নিজেদের অসদাচরণ ও অধার্মিক জীবন যাপনের ফলে তারা জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি হারাল। এই উচ্চতর যাজক সম্প্রদায় ফরাসি বিপ্লবের জন্য কিছুটা দায়ী ছিল। অন্যদিকে নিম্নশ্রেণির যাজকদের অবস্থা ভালাে ছিল। তাদের কোন বিশেষ সুযােগ-সুবিধা ছিল না। ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত কর্তব্য তারাই সম্পন্ন করত। এই কারণে কৃষককূলের উপর তাদের বেশ প্রভাব ছিল। উচ্চতর যাজকদের কাছ থেকে কোন সুবিধা আদায় করা যাবে না বলে নিম্নস্তরের যাজকরা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তৃতীয় শ্রেণির সাথে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে ফেলল।

কৃষক সমাজ : ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে কৃষক শ্রেণির ভূমিকা অগ্রাহ্য করার মত নয়। তৎকালীন ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল কৃষক। অতএব প্রাক্-বিপ্লব ফ্রান্সের আড়াই কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটি ছিল কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত। এই কৃষকশ্রেণি যদি বিপ্লবে যােগ না দিত, তাহলে বিপ্লব, দেখা দিত কিনা সন্দেহ। ফ্রান্সের আবাদযােগ্য জমির ৩৫ শতাংশের মালিক ছিল কৃষকরা। ফ্রান্সের সব অণ্ডলের । কৃষকদের অবস্থা একই প্রকার ছিল না। কৃষকদের মধ্যে স্ববিরােধিতা ছিল। এটা থাকলেও সব শ্রেণির কৃষকই সুবিধাভােগী শ্রেণির শােষণের অবসান চাইছিল। অভিজাত, রাজা, চার্চ, সকলকেই কৃষকদের নানা কর দিতে হতাে। ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিপ্লবের প্রাককালে সমগ্র কৃষক সমাজ সামন্ততান্ত্রিক করব্যবস্থার উচ্ছেদ চেয়েছিল।

শহুরে জীবন : কৃষক সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য অবহেলিত দরিদ্র মানুষ তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের মধ্যে শহরের জনতার ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। তাদের বলা হতাে সাঁ-কুলৎ। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতকের শুরুতেই আধুনিক শহর-জীবন শুরু হলে গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ শহরে আসতে থাকে রুজি-রােজগারের জন্য।

অষ্টাদশ শতকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহের ব্যয় বৃদ্ধি পায় কিন্তু আয় সেরূপ বৃদ্ধি না পাওয়ায় সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য। সাধারণ মানুষের দুর্গতি বাড়ে। ঐতিহাসিক লাব্রুস প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের শহরগুলিতে সাধারণ মানুষের খরচার তালিকায় খাদ্যশস্যের ব্যয়ে তার আয়ের অর্ধেক চলে যেত বলে উল্লেখ করেছেন।

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা

আর্থিক দুরাবস্থা : ফ্রান্সের অর্থনৈতিক দুরবস্থা বিপ্লব আনতে বিশেষ সাহায্য করেছিল। ফ্রান্সে সকল সুখ-সুবিধা ধনী, অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় ভােগ করতাে। তাদের কোনরকম কর দিতে হতাে না। সামন্ততন্ত্রের নীতি অনুসারে কৃষকরা বেগার খেটে মরতাে। আর অভিজাতেরা নিশ্চিত বিলাসে দিন-যাপন করত। দেশের ভাল ভাল জমি তাদের দখলে ছিল। রাষ্ট্রের ভাল ভাল চাকরি তারাই পেতাে। রাষ্ট্রের সমগ্র আয়ের প্রায় সমস্তটাই সাধারণ প্রজাদের কাছ থেকে নেওয়া হতাে।

কর ব্যবস্থা : করধার্য সম্পর্কে কোন ন্যায় সঙ্গত নীতি ছিল না, ফ্রান্সে প্রধানতঃ তিনটি প্রত্যক্ষ কর জনসাধারণের উপর ধার্য করা হতাে, যথা—‘টেইলি’, ‘ক্যাপিটেশন’ এবং ভিংটিয়েমে। এই করগুলি কখন কিসের উপর ধার্য হবে তা করদাতারা জানতেন। তাছাড়া পরােক্ষ করের সংখ্যা ছিল অগণ্য। ফ্রান্সের এক এক অঞ্চলে লবনের জন্য এক এক রকম দাম আদায় করা হতাে।‘টেইলি’—নামক কর কখনাে জমির উপর ধার্য হতাে, কখনাে আয়ের বিভিন্ন উৎসের উপর ধার্য হতাে।

এরূপ অবস্থায় কোন ন্যায় বিচার ছিল না। রাজসভার অমিতব্যয়িতার ফলে। জনগণের উপর বেশি পরিমাণে কর ধার্য করা হতে থাকে। কৃষকদের সর্বাপেক্ষা বেশি কর দিতে হতাে। তাদের আয়ের ৫৩ ভাগ দিতে হতাে সরকারকে ভূমিকর বা টেইলি হিসেবে, শতকরা ২৮ ভাগ দিতে হতাে গীর্জা’ কর এবং জমিদারদের সামন্তপ্রথা অনুযায়ী কর। এছাড়া পরােক্ষ কর দিতে হতাে। উৎপাদন শুল্ক ও লবন শুল্কের মাধ্যমে সরকার এটি আদায় করতাে।

গিল্ড ব্যবস্থা : ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গিও সংকীর্ণ ছিল। গিল্ড দেশের শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতাে এবং বিভিন্ন গিল্ডগুলি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্ৰাধীনে। শিক্ষানবীশ কর্মীদের স্বাধীন। কাহিগর হবার সুযােগ ছিল না। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ও অল্প মজুরী তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করেছিল। কারিগরদের অবস্থাও ভাল ছিল না। কিন্তু শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই ভাল ছিল। তবে অভ্যন্তরীণ করভার, প্রাদেশিক শুল্ক, রাজপথ, নদীপথ, নগর শুল্ক প্রভৃতি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বাধার সৃষ্টি করছিল। এই কারণে ব্যবসায়ীরা। সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।

মূল্যায়ন : ক্রমাগত ঘাটতি রাজস্ব সত্ত্বেও ফ্রান্স যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হয়। ফলে ফ্রান্সের আর্থিক তহবিল আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদেশে ফ্রান্সের আর্থিক মর্যাদা বলে কিছু কিছু চিল না, রাজকোষ শূন্য, জাতীয় ঋণের তহবিল দিনের পর দিন স্ফীত হলাে। এমন কী জাতীয় ঋণের সুদ প্রদানেরও ক্ষমতা রইল না। এই শােচনীয় আর্থিক অবস্থা থেকে রক্ষা পাবার জন্য যােড়শ লুই ১৭৫ বছর ধরে উপেক্ষিত স্টেট জেনারেল মহাসভা আহ্বান করলেন। সুতরাং ফ্রান্সের আর্থিক দুর্গতি বিপ্লবের অন্যতম কারণ বলা যায়।

তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বলে মনে করেন না। তারা অবশ্য স্বীকার করেন যে, বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়। এই সংকটই অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় গােটা দেশ গণ বিক্ষোভ দেখা দেয়, যা বিপ্লবের সূচনা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক অবশ্য অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক সংকটকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

Leave a reply