Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

গুপ্তযুগকে ভারতের সুবর্ণযুগ বলা যায় কি?

গুপ্তযুগকে ভারতের সুবর্ণযুগ বলা যায় কি

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর পাঁচশো বছর ধরে ভারতে কোন ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ও সার্বভৌম শক্তি ছিল না। এর মধ্যে কুষাণ এবং সাতবাহনরা ভারতের কিছু অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য পুনঃস্থাপিত হয় নি। বিশেষতঃ কুষাণ ও সাতবাহন বংশের পর ভারতের রাজনীতিতে এক চরম বিচ্ছিন্নতা ও অন্ধকারময় যুগের সৃষ্টি হয়। ভারতের রাজনীতির এই জটিল পরিস্থিতিতে, কুষাণ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে মগধে গুপ্তরাজাদের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় ঘটলে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। গুপ্তরাজারা ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠন করেন এবং এক অতি উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির সূচনা করেন।

গুপ্তযুগ প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনে এক গৌরবময় যুগ। এই যুগে রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই অগ্রগতির কথা চিন্তা করে গুপ্তযুগকে ভারত ইতিহাসে “সুবর্ণযুগ” (Golden Age) বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক বার্নেট্ (Barnett) এর মতে গুপ্তযুগ প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসে ‘পেরিক্লিসের যুগের’ সঙ্গে তুলনীয়। ডঃ ভি. স্মিথ গুপ্তযুগকে ‘এলিজাবেথীয় যুগ’-এর সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের মূলে ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগের ফলেই যে গুপ্ত সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থায়িত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা ও সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা এসবের ফলে ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল প্রধানত ভারতীয় মনীষা ও উদ্যোগের ফসল।

সাহিত্য, দর্শন ও ব্যাকরণের বিকাশ

গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার প্রভূত উন্নতি ঘটে। শুধু সংস্কৃত কাব্য ও সাহিত্যই নয়, লিপি ও মুদ্রা নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই যুগে সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যায়। এইজন্য ঐতিহাসিক ‘স্মিথ’ গুপ্তযুগকে ‘সংস্কৃত ভাষার পুনরুভ্যুদয়ের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

গুপ্তযুগে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য, দুদিকেই অসামান্য অগ্রগতি দেখা যায়। ধর্মীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে নারদ, বিষ্ণু, যাজ্ঞবল্ক্য, মনুসংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্র সংকলিত হয়েছিল। এই যুগে বসুবন্ধু, চন্দ্রগোমিন প্রভৃতি বৌদ্ধ দার্শনিকেরা অমূল্য দর্শনশাস্ত্র রচনা করেছিলেন। গুপ্তযুগের ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের মধ্যে নাটকের স্থান ছিল সবার আগে। এই যুগেই ‘ভাস’ ১৩টি নাটক রচনা করেছিলেন। মহাকবি ‘কালিদাস’ রচিত শকুন্তলা, মেঘদূত, কুমারসম্ভব প্রভৃতি কাব্য ও নাটক ছিল সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই যুগের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল শূদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’, বিশাখদত্ত রচিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ ও বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র। হরিষেণ রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’র রচনাশৈলী ছিল কাব্যের মত শ্রুতিমধুর। কাব্যচর্চার জন্য সমুদ্রগুপ্ত “কবিরাজ” উপাধিতে ভূষিত হন।

গুপ্তযুগে সামাজিক অনুশাসন ও ইতিহাসমূলক রচনার পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি, বিষ্ণুপুরাণ, গরুড় পুরাণ, কিন্দ পুরাণ প্রভৃতি স্মৃতি শাস্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থ এই সময়ে পরিবর্ধিত হয়। বিখ্যাত বৈয়াকরণ ভর্তৃহরি ও দার্শনিক কুমারিল ভট্ট এ যুগের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। গুপ্তযুগে সাহিত্যের মত দর্শনের ক্ষেত্রেও বহু মৌলিক তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। এ যুগে ‘সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, মীমাংসা, বেদান্ত ও বৈশেষিক’—এই ৬টি দর্শনের উদ্ভব হয়। দর্শন ছাড়াও পাণিনিও পতঞ্জলির ওপর ভিত্তি করে এই যুগে সংস্কৃত ব্যাকরণের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।

বিজ্ঞান, ধাতুবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিদ্যা

প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে গুপ্তযুগের অবদান কালজয়ী। এই যুগে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র অর্থাৎ বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রেই সৃজনশীল উৎকর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট (জন্ম ৪৭৬ খ্রীঃ) এই যুগের এক বরেণ্য সন্তান। পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির মতবাদ তাঁর চিন্তাপ্রসূত। এই যুগের অন্যান্য খ্যাতনামা বিজ্ঞানী হলেন বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ। বরাহমিহিরের ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ ও ‘ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত’ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে এক অনন্য সম্পদ। গণিত শাস্ত্রের ক্ষেত্রে এই যুগেই শূন্যতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল।

চিকিৎসা শাস্ত্রে বানভট্ট ও ধন্বন্তরীর অবদান বিশেষ স্মরণীয়। ধাতু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। দিল্লীর চন্দ্ররাজ নামাঙ্কিত লৌহ স্তম্ভটি এই যুগেই নির্মিত হয়। আজ পর্যন্ত এই স্তম্ভে মরচে ধরেনি। নালন্দায় প্রাপ্ত তাম্র নির্মিত বুদ্ধমূর্তি গুপ্ত যুগের ধাতু শিল্পের অগ্রগতির আর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা

ঐতিহাসিক ডঃ স্মিথ মন্তব্য করেছেন—স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এই তিনটি শিল্পকলার অসাধারণ বিকাশ গুপ্তযুগে ঘটেছিল। এযুগের স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পাহাড় খোদাই করে গৃহনির্মাণ। মন্দির শিল্পে এই যুগে অগ্রগতি ছিল বিস্ময়কর। গুপ্তযুগে নির্মিত ভিতরগাঁও ও দেওগড়ের মন্দিরের গঠন শৈলী ও আলংকারিক কারুকার্য চমকপ্রদ। পার্সি ব্রাউনের মতে দেওঘরের দশাবতার  মন্দিরটি এই যুগে শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন। এই যুগে পাহাড় কেটে বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুদের জন্য গুহা তৈরী করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে ইলোরা ও অজন্তার গুহাগুলি সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। পৌরাণিক আখ্যান ও উপাখ্যান অবলম্বন করে কৃষ্ণ, বিষ্ণু, শিব ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি এ যুগের ভাস্কর্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে অজন্তা, ইলোরা প্রভৃতি গুহার দেওয়ালে অঙ্কিত চিত্রগুলি আজও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

গুপ্তযুগের সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনীতি সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। এই সময় জাতিভেদ ও বর্ণ ব্যবস্থা প্রথা পূর্বের তুলনায় অধিক জটিলতা প্রাপ্ত হয়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পাঠকের ভাষা প্রকাশের মাধ্যমে। শুধু তাই নয় গুপ্তযুগের শিল্প সাহিত্যে সবত্রই সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ পরিচয় বার বার লক্ষ্য করা গেছে।

ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, অনুকূল সামাজিক পরিবেশ, সুস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গুপ্ত রাজাদের অনুকুল পৃষ্ঠপোষকতাতেই গুপ্তযুগে শিল্প, স্থাপত্য, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। এই সব ক্ষেত্রে ভারতীয় মণীষার বিকাশ ও অগ্রগতি ইতিপূর্বে অন্য কোন যুগে দেখা যায় নি। সেই অর্থে নিঃসন্দেহে গুপ্তযুগকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতের সুবর্ণযুগ বলা যায়। অবশ্য আধুনিক কালের ঐতিহাসিক মহলে কেউ কেউ গুপ্তযুগকে সুবর্ণ যুগ বলে মেনে নিতে রাজী নন। অধ্যাপক ডি. এন. ঝা প্রমুখের মতে, গুপ্তযুগে নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উৎকর্ষ সত্ত্বেও এই যুগেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে কৃষকেরা ভূমিদাসের স্তরে নেমে আসে। ভারতীয় নারীদের পূর্বতন মর্যাদা অনেকাংশে খর্ব করা হয় এবং তারা এ সময়ে পুরুষের কর্তৃত্বের অধীনস্থ হয়। নারী জাতির এই অবনমন দেশ ও সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি। এছাড়া, গুপ্তযুগে বর্ণপ্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পায়। অস্পৃশ্যগণ সামাজিক জীবনে একেবারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। তাই সামগ্রিক বিচারে গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলা যুক্তিযুক্ত নয়।

Leave a reply