Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে কয়েকটি উদাহরণসহ শিলালিপি ও মুদ্রার গুরুত্ব নির্ণয় কর?

সাধারণত খননকার্য চালিয়ে মাটির তলা থেকে অতীত দিনের তৈরী বা অতীতে ব্যবহার করা যে সকল দ্রব্য সামগ্রিক আবিস্কৃত হয় তাকেই আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলি। লেখ মালার মুদ্রা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য মাটি, পাথর ধাতুর তৈরীর জিনিস অস্থি বিশেষে ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে পড়ে। পুরাতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। প্রত্নবস্তুর কাল নির্ণয়ের জন্য কার্বণ ১৪, থার্মো-লুমিনোসেন্স প্রভৃতি পরীক্ষা আজ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া বলে গণ্য হয়ে থাকে।

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে “লেখমালার” গুরুত্ব বিশেষ স্মরণীয়। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্যরাজ অশোক ইরানের রাজাদের অনুকরণে ভারত উপমহাদেশে লেখার ব্যবহার শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সর্বপ্রাচীন লেখাটি হল পারস্যরাজ ১ম দারয়বৌষের উৎকীর্ণ বেহিস্তণ লেখা। এছাড়াও তাঁর উৎকীর্ণ অপর লেখাগুলি হল পার্সেপোলিস ও নকশ্-ই-রস্তম। এই লিপিগুলিতে গান্ধার সিন্ধু অঞ্চলের কথা উল্লেখ আছে।

ভারতের ইতিহাসে রাজা অশোকের লেখাসমূহের এক বিশেষ অবদান আছে। এই লেখগুলি সাধারণত প্রাকৃত ও ব্রাহ্মী খরোষ্ঠী হরফে লিখিত। প্রসঙ্গত স্মরণীয় বখ অঞ্চলের প্রজাদের জন্য তিনি গ্রীক ভাষাতেও কয়েকটি লিপি উৎকীর্ণ করেছিলেন। অশোকের লিপি পাঠোদ্ধার করেন ১৮৩৭ সালে ইংরেজ পণ্ডিত জেমস প্রিনসেপ। অশোকের লেখে প্রতিফলিত হয়েছে “প্রজাপালক”, মহাপ্রাণ এক রাজার অন্তরের আকুতি, রাজ্যজয়ে অনিহা, প্রজাদের তিনি সন্তানস্নেহে পালন করে, রাজ্যময় ভ্রমণ করে জনকল্যাণের কাজ করা, নিজরাজ্যে ও পররাজ্যে জনহিতকর কাজের ব্রতী হওয়া, দেশে, বিদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য উদাথ আহ্বান জানিয়ে গেছেন।

মৌর্য পরবর্ত্তী কালের লেখগুলিতে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

(১) সরকারি-এই লেখগুলি অধিকাংশই প্রশস্তিবাচক ও ভূমিদান বিষয়ক।

(ক) মন্ত্রী হরিষেনের লেখা সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভ লেখ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এখানে সমুদ্রগুপ্তকে শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, কবি, সঙ্গীত শিল্পী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

(খ) কলিঙ্গরাজ খারবেলের খোদিত হাতীগুম্ফা লেখ—এই লেখমালায় রাজা খারবেলের রাজ্যজয় ও জৈন ধর্মানুরাগের কথা উল্লেখ আছে।

(গ) গৌতমী পুত্রের নাসিক লেখ ও মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামার জুনাগড় লেখ-পুত্রহারা বৃদ্ধা রাণী পুত্রের রাজ্যজয় ও সমাজ সংস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্য লেখতে রুদ্রদামার রাজ্য জয় কথা উল্লেখ আছে।

(ঘ) কর্ণাটকের হরিসেনের রচিত আইহোল প্রশস্তি থেকে দক্ষিণ ভারতের চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী, মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র প্রশস্তি থেকে প্রতিহাররাজ ১ম ভোজের এবং বাংলার দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে সেনরাজ বিজয়সেনের রাজ্যজয়ের কথা জানা যায়।

(ঙ) মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত এরান লেখ থেকে গুপ্ত সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের অসংখ্য সাফল্যের কথা জানা যায়।

আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত রাজকীয় সরকারী অভিলেখগুলি অধিকাংশই পাথরের উপর উৎকীর্ণ হত। কিন্তু চতুর্থ-পঞ্চম শতক থেকে এক নতুন ধারা দেখা গেল—যা হল রাজকীয় লেখ গুলি প্রধানত জারি হতে থাকে তাম্রপট্টের উপর। এই গুলিকে বলা হয় “তাম্রশাসন”। এইগুলি কখন একক আবার কখন একাধিক তাম্র শাসন একটি ধাতব আংটা দিয়ে আটকানো থাকত। তাম্রশাসনের প্রথম অংশে দীর্ঘ রাজনৈতিক ভূমিকা থাকত। এইরূপ রাজকীয় প্রশস্তির অন্যতম উদাহরণ হল পালরাজা ধর্মপালের “খলিমপুর তাম্রশাসন”।

২। ভারতীয় লেখমালার অধিকাংশই কিন্তু বেসরকারি। এই লেখমালা গুলি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎকীর্ণ হয়েছিল। সাধারণত ভূমিদান, মন্দির, বিহার, স্তূপ এবং মূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এইরূপ লেখ খোদিত হত। এই গুলি অধিকাংশ খোদিত হত পাথরের গাত্রে পরবর্তীকালে তাম্রফলকে। এই ধরনের লেখে সন-তারিখ এবং রাজা, বা প্রতিষ্ঠাতার অথবা তার পূর্ব পুরুষদের সম্বন্ধে সামান্য কিছু তথ্য উল্লেখ থাকত। মূর্ত্তির গাত্রেও অথবা মূর্ত্তির পৃষ্ঠদেশে খোদিত থাকত নানা তথ্য।

প্রাচীন লেখগুলির বহুবিধ উপযোগিতা থাকলেও তার যে সীমাবদ্ধতা ছিল—তা অজানা নয়। যেমন—

(ক) দুস্পাঠ্য অক্ষরের জন্য পাঠোদ্ধারে কঠিন।

(খ) সন-তারিখের অস্পষ্ট উল্লেখ।

(গ) অধিকাংশই রাজকীয় প্রশস্তি থাকায় প্রকৃত ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে মতানৈক্য তৈরি হয়।

(ঘ) রচয়িতারা অধিকাংশই রাজকীয় আনুকূল্যে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার ফলে তারা অনেক সময়ই তথ্যের অতিরঞ্জন করতেন।

(ঙ) সমাজের নিন্ম শ্রেণীর কথা লেখগুলিতে খুব কমই থাকত যার ফলে সকল শ্রেণীর ইতিহাস লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও লেখের গুরুত্ব ভারতীয় ইতিহাসে অপরীসীম।

মুদ্রা

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে ‘মুদ্রার’ গুরুত্ব অপরীসীম। খ্রীষ্ট-পূর্ব ৬-৫ম শতক মধ্যে ভারতে মুদ্রার ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল। “ছাপমার” (PUNCH MARKED COIN) মুদ্রাই এই দেশের প্রাচীনতম মুদ্রা। নির্দিষ্ট ওজনপূর্ণ ধাতব খন্ড যখন বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত তাকেই মুদ্রা বলা হত। ভারতের প্রাচীন মুদ্রা গুলি কে বা কারা প্রচলন করে ছিল সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। প্রথম পর্বে ধাতব খন্ড গুলির গায়ে কতকগুলি প্রতীকী নকশা দেখা যেত।

শাসকের নাম ও প্রতিকৃতি যুক্ত মুদ্রা ভারতে প্রথম দেখা গেল বাহ্লীক গ্রিক রাজাদের সময় থেকে। এই গ্রীক রাজারা দ্বিতীয় ও প্রথম খ্রিস্ট পূর্বাব্দ আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করতেন। কোন প্রাচীন গ্রন্থে এদের সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নেই। এদের রাজত্বকাল, বংশ পরিচয়, নাম মুদ্রা থেকেই জানা যায়।

বিভিন্ন প্রকার ধাতু দিয়ে মুদ্রা গুলি তৈরি হত। ভারতে স্বর্ণমুদ্রার আবির্ভাব ঘটে কুষাণ রাজা বিম কদফিসেস এর রাজত্বকালে। অধিকাংশই মুদ্রা কোন না কোন রাজার নির্দেশে বা স্মরণীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হত। তার কয়েকটি ঘটনাসহ নিম্নে উদাহরণ দেওয়া হল:

(১) মৌর্য পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতের গ্রীক রাজাদের বিভিন্ন তথ্য মুদ্রা থেকেই জানা যায় কোন লেখমালায় এদের কোন উল্লেখ নেই।

(২) শক-সাতবাহনদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে বিরোধ চলেছিল তার অনেক তথ্য পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রের “জোগলথেস্বি” প্রাপ্ত মুদ্রাগুলি থেকে। এখানে পাওয়া যায় শকরাজ নহপাণের প্রচুর পরিমাণের রৌপ্যমুদ্রা। পরবর্তী সময় এই মুদ্রাগুলির উপর গৌতমী পুত্র সাতকর্ণী তার নিজ নাম ছাপ (PUNCH) করেছিলেন।

(৩) গুপ্তরাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক শাসনের অবসান ঘটান। কিন্তু তার কোন প্রমাণ কোন লেখমালায় নেই—একমাত্র প্রমাণ পাওয়া যায় তার নির্মিত শক রাজাদের অনুরূপ রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন। এছাড়াও গুজরাট জয় করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত “সিংহ শিকারী” প্রতিকৃতি যুক্ত মুদ্রা প্রচলন করেন।

(৪) মৌর্যোত্তর যুগে ভারতে মালব, যৌধেয় প্রভৃতি অনেকগুলি “গণরাজ্য” ছিল। এদের সম্বন্ধে তথ্য জানা যায় এক মাত্র তাদের প্রচলিত তাম্রমুদ্রা গুলি থেকেই।

(৫) ব্যবসা বাণিজ্যের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে মুদ্রার অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। মুদ্রা থেকে অর্থনৈতিক ইতিহাস কিভাবে জ্ঞাত হয় তার কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করা হল:-

(ক) খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৫ম শতকে যখন মুদ্রার প্রচলনের সূচনা হল—তার অগ্রগতি হয়েছিল উত্তর ভারত ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই।

(খ) প্রতিটি মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট ওজন থাকত এবং তার ধাতব বিশুদ্ধিও বজায় রাখা হত। সাধারণত মুদ্রার ওজন ও ধাতব বিশুদ্ধতার হ্রাস ঘটলে সেই সময়ের আর্থিক সংকটের ইঙ্গিত দিত।

(গ) এক স্থানের মুদ্রা অন্য স্থানে প্রাপ্ত হলে বাণিজ্যিক লেনদেনের যেমন আভাস পাওয়া যায় তেমনি রাজাদের রাজত্বের সীমানার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রোম ভারত বাণিজ্যের অগ্রগতি এক স্মরণীয় উদাহরণ।

(ঘ) ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও মুদ্রার অবদান স্মরণীয়। মুদ্রার গৌণদিকে বিভিন্ন দেবদেবী মূর্তি খোদিত থাকে। এর দ্বারা যেমন বিভিন্ন সময়ের ধর্মবিশ্বাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। আবার মূর্তিতত্ত্বের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন গুপ্তযুগের রাজাদের স্বর্ণমুদ্রায় তাদের মনোহর নমনীয় দেহভঙ্গিমা তা ভারত শিল্পকে এক কথায় ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে।

তবে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুদ্রার তথ্য পাঠে বেশ কিছু অসুবিধাও দেখা যায়। যথা –

(১) অনেক সময় মুদ্রায় রাজার নাম স্পষ্ট ভাবে থাকে না, যার ফলে তা পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

মুদ্রায় যে ছবি খোদিত থাকে তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। যেমন ১ম কুমার গুপ্তের “অপ্রতিম” শ্রেণীর মুদ্রা গুলি উল্লেখ করা যায়।

পরিশেষে তবু উল্লেখ করতে হয় মুদ্রা হল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার এক নব দিগন্ত।

Leave a reply