Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর মারাঠারা একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলো কেন?

শিবাজীর আদর্শে অনুপ্রাণীত মারাঠা জাতি, পেশােয়াদের সুযােগ্য নেতৃত্বে ভারতবর্ষের এক প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের পর থেকেই তাদের পতন শুরু হয়। অবশ্য পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের (১৭৬১খ্রিঃ) কয়েক বছরের মধ্যেই মারাঠাগণ পুণরায় শক্তি সঞ্চয় করে উত্তর ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিল। তথাপি তাদের এই পুনরুজ্জীবন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। কারন মারাঠাদের নব জ্যোতিষ্ক পেশােয়া প্রথম মাধব রাওয়ের আকস্মিক মৃত্যুর (১৭৭২খ্রিঃ) ফলে মারাঠা ভাগ্যাকাশে ঘাের অমানিশা দেখা দেয়। ফলে মারাঠাগণ শুধু সাম্রাজ্য গঠনেই অকৃতকার্য হয়েছিল এমন নয়। তারা আত্মরক্ষার ক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত হারিয়েছিল। এর বহুবিধ কারণ ছিল—

১) ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তি

প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মারাঠা সাম্রাজ্যের কাঠামাে শিবাজীর ব্যক্তিগত প্রতিভাকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছিল। কোন আত্মিক অনুপ্রেরণা বা জাতীয়তাবােধে সাধারণ মারাঠাদের অন্তরকে স্পর্শ করেনি। স্বাভাবিকভাবেই বন্ধনহীন মারাঠা ঐক্য পরবর্তীকালে সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অভাবে দ্রুত ভেঙে পড়েছিল। আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন, “মারাঠাদের ঐক্য ছিল যেমন কৃত্রিম, তেমনি আকস্মিক এবং সেই কারণেই অনিশ্চিত।”এই মৌলিক ত্রুটির জন্যই মারাঠা প্রকৃত শক্তি সঞ্জয় করতে সমর্থ হয়নি।

২) অর্থনৈতিক দুর্বলতা 

মারাঠা দেশ পর্বত সংকুল। কৃষি, শিল্প বা বাণিজ্য গড়ে তুলবার সুযােগ স্বভাবতই সেখানে ছিল না। একারণে মারাঠা রাষ্ট্রকে চৌথ, সরদেশমুখী প্রভৃতি অনিশ্চিত আয়ের উপর নির্ভর করতে হত। স্থায়ী রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে এইরূপ জবরদস্তি ও অনিশ্চিত আয় মােটেই সহায়ক ছিল না। তাই স্বভাবতই মারাঠা রাষ্ট্রের পতন ঘটে।

৩) জায়গীর প্রথার পুনঃপ্রবর্তন

শিবাজীর পরবর্তীকালে মারাঠা রাজ্যে জায়গীর প্রথা পুনঃপ্রবর্তিত হবার ফলে রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট হয়েছিল। জায়গীরদারগণের স্বার্থপরতা রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরােধী ছিল। তাদের পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ক্রমেই মারাঠা ঐক্য বিনষ্ট করে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল।

৪) আত্মকলহ

প্রথম মাধবরাওয়ের মৃত্যুর পর মারাঠাদের মধ্যে আত্মকলহ ও ষড়যন্ত্রপ্রিয়তা দেখা দিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবেই মারাঠাগণইংরজেদের মতাে প্রবল শত্রুর। সাথে লড়াই করার প্রয়ােজনীয় ঐক্যবােধ, দৃঢ়তা ও মর্যাদাবােধ হারিয়েছিল। ব্রিটিশ শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে যুঝবার প্রয়ােজন উপলদ্ধি না করে তারা আত্মকলহে নিজেদের দুর্বলতা বাড়িয়ে তুলেছিল।

৫) প্রাচীন আদর্শ ত্যাগ 

মারাঠাদের ‘হিন্দুপাদ-পাদশাহী’আদর্শ ত্যাগ ও মুসলমান সৈন্য নিয়ােগ তাদের জাতীয়তাবােধ হ্রাস করেছিল। অপরাপর জাতির লােক থেকে ভাড়া করা সৈন্য নিয়ােগের রীতি মারাঠাদের সামরিক দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইহাও তাদের পতনের অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ্য।

৬) দক্ষ নেতার অভাব

শিবাজী, বালাজী বিশ্বনাথ, প্রথম বাজীরাও, সিন্ধিয়া, নানা ফড়নবিশ প্রমুখ কয়েকজন ছাড়া মারাঠা জাতির মধ্যে দক্ষ নেতার আবির্ভাব ঘটেনি। অধিকাংশ নেতাই ছিলেন দুরদৃষ্টিহীন ও জাতীয়তাবােধহীন ব্যক্তি। প্রতিপক্ষ ইংরেজদের কূটবুদ্ধির সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা কারােরই ছিল না, ফলে ইংরেজরা খুব ধীরে ও সুপরিকল্পিতভাবে মারাঠাদের সংহতি বিনষ্ট করতে থাকে।

৭) আনুগত্যহীনতা

মারাঠা ব্যবস্থা ছিল স্বৈরাচারী। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য বলে কিছু ছিল না। এই ধরণের ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নির্ভর করে শাসকের দক্ষতা, যােগ্যতা ও জনপ্রিয়তার উপর। নেতারা সবাই ছিলেন অযােগ্য। উপরন্তুলুণ্ঠন, অত্যাচার প্রভৃতির দ্বারা অর্থোপার্জনের ফলে মারাঠা রাজ্যের প্রতি পার্শ্ববর্তী রাজ্য বা জনসাধারণের সহানুভূতি ছিল না। এগুলিও মারাঠা জাতির পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।

৮) সামরিক ত্রুটি

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে মারাঠাগণ তাদের চিরাচরিত গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি ত্যাগ করে ভীষণ ভুল করেছিল। কারণ পর্বত সংকুল অঞ্চলে এই পদ্ধতি ছিল খুবই কার্যকরী। তাছাড়া আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ও ইউরােপীয় যুদ্ধাস্ত্রে ও যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করা মারাঠাদের পক্ষে স্বভাবতই সম্ভব ছিল না

৯) বর্ণভেদজনিত বিরােধ

ঐতিহাসিক রাণাডে মারাঠা সাম্রাজ্যের একটি ত্রুটির দিকে। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রাণাডে মনে করেন, মারাঠাদের সামাজিক সংহতির অভাবে মারাঠা শক্তিকে দুর্বল করেছিল। বর্ণভেদ সামাজিক সংহতির প্রতিবন্ধক ছিল। অ্যাংগ্রিয়া ও পেশােয়াদের বিরােধে বর্ণভেদজনিত ঈর্ষার ভূমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। রাণাডে বলেছেন যে, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে যােগ্যতা নয়, গােষ্ঠী ও বর্ণের ভিত্তিতে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হত। পেশােয়ারা ছিলেন ব্রাত্মণ, তাই পেশােয়া শাসনে উপকৃত হত ব্রাহ্মণরা।ব্রাত্মণদের প্রতিপক্ষপাতিত্ব শুধু সামাজিক সংহতি বিনষ্টকরেনি, আর্থিকসংহতির ওপরেও চাপ সৃষ্টি করেছিল।

১০) শিক্ষার অনগ্রসরতা

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার ও সুরেন্দ্রনাথ সেনের মতে, মারাঠা সাম্রাজ্যে সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ না হওয়ায় কোন সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ মারাঠা সমাজে হয়নি। সমাজ শুধু অনগ্রসর ছিল না, নানাবিধ দুষ্ট ক্ষত সমাজে দেখা দিয়েছিল। ইন্দ্রিয়াসক্তি, মদ্যপান, লঘু আমােদ-প্রমােদ মারাঠা সর্দারদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। সামাজিক অনগ্রসরতা ও অবক্ষয় মারাঠা শক্তির পতনের অন্যতম কারণ বলে ঐতিহাসিক আর.ডি. নাদকার্ণি মনে করেন।

পরিশেষে বলা যায় আভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ত্রুটি, স্বার্থপরতা, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব, আদর্শহীনতা প্রভৃতি বিভিন্ন কারণের জন্য সুযােগ থাকা সত্ত্বেও মারাঠাগণ ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্যের ইমারত গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল।

Download PDF

Please wait..
If the download didn’t start automatically, click here.

Leave a reply