Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ও তার ফলাফল বর্ণনা কর।

পঞ্চদশ শতকে ইউরােপে নবজাগরণের আবির্ভাব ঘটেছিল। নবজাগরণের। পটভূমি হিসাবে ইউরােপে সমাজ রাজনীতির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইউরােপের রূপান্তর পর্বে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার, যা মুদ্রণবিপ্লব নামে খ্যাত। সম্ভবত, অষ্টম শতকে চীনদেশে মুদ্রণযন্ত্র প্রথম আবিষ্কার হয়। কাঠের ব্লক বা Zylography বা Block Printing-এর উদ্ভাবন পুস্তক রচনার ইতিহাসে পুঁথি লেখার পর্ব শেষ করে ‘বই’-এর পর্বের–সূচনা হয়। মুদ্রণব্যবস্থা আবিষ্কৃত হবার আগেও বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পেছনে বইপাঠের এই অভ্যাস অবশ্যই প্রভাব ফেলেছিল। প্রাক্-মুদ্রণ পর্বে বই বলতে ছিল পুঁথি। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে হাতে লেখা পুঁথির সামাজিক মূল্যও ছিল ব্যাপক। ঐতিহাসিকেরা দুধরনের হাতে লেখা পুঁথির উল্লেখ করেছেন—(১) মঠের যুগের পুঁথি এবং (২) ধর্ম নিরপেক্ষ যুগের পুঁথি। রােম সাম্রাজ্যের পতনের পরে প্রায় ৭০০ বছর পুঁথি রচনার কাজে মঠ ও অন্যান্য ধর্ম প্রতিষ্ঠানের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। দ্বাদশ শতক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, বুর্জয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ইত্যাদি পুঁথি রচনার ও অনুবাদের কাজটিকে আস্তে আস্তে পাল্টে দেয়। পুঁথি রচনার এই secular যুগে (১৩-১৫ শতক) পুঁথির অলংকরণ এ সৌষ্ঠবে পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগতভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময় পার্চমেন্ট বা ভেড়ার চামড়া থেকে তৈরী পাতার পরিবর্তে কাগজের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য কাগজ ব্যয়বহুল হওয়ায় সমান্তরালভাবে পার্চমেন্টের ব্যবহারও অব্যাহত ছিল। দ্বাদশ শতক থেকে পুঁথি রচনার ওপর মাঠের একাধিপত্য শিথিল হতে থাকে। কারণ এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠরত শিক্ষার্থীরা কোন ধর্মীয় সংঘের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে শুরু করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পুঁথি রচনার জন্য নিজস্ব দপ্তর গড়ে তােলে।

দ্বাদশ শতকের পরবর্তীকালে এক নতুন পাঠক সমাজের উদ্ভব ঘটেছিল। অভিজাত ও যাজকদের পাশাপাশি এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথ্য বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। আইনজীবী, সরকারী কর্মচারী, ধনী-বণিক, শহরে বৃত্তিজীবী প্রভৃতি প্রত্যেকরই বই প্রয়ােজন ছিল। বলাবাহুল্য পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পুঁথির চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সম্ভবত, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি বিক্রেতারা সাধারণ পাঠকের মধ্যেও পুঁথির লেনদেন সংগঠিত করতেন। ১৪৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ফ্লেমিস-এর ভাষায় লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে, জনৈক পুস্তক বিক্রেতা একজন নকল নবীশকে প্রায় ৪০০ কপি পুঁথি সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার প্রাক্-মুহূর্তে পুঁথি বইয়ের একটি বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে।

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি মুদ্রণযন্ত্র ও বারবার ব্যবহারযােগ্য টাইপ (type) আবিষ্কার মুদ্রণ বিপ্লবের সূচনা করে। মুদ্রণ বিপ্লবের আবশ্যিক অনুসঙ্গ হল কাগজ। আরবরা দ্বাদশ শতকে স্পেনে কাগজ প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। কাগজ তৈরীর পদ্ধতি ক্রমশ ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। পুরানাে ছেড়া কাপড়ের সঙ্গে flax বা hemp মিশিয়ে একধরনের মােটা কাগজ তৈরী হত। পুনর্ব্যবহারযােগ্য টাইপ ও কাগজের সমন্বয়ে মুদ্রণশিল্পকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়ােজন ছিল কালির। এই সময়ে ছাপার কালি তৈলাক্ত করার প্রক্রিয়াও ইউরােপের করায়ত্ত হয়েছিল। তেলমিশ্রিত রঙের ব্যবহার মুদ্রণের কাজ সহজ করেছিল।

ধাতুর সাহায্যে মুদ্রণের সূত্রপাত হয় ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। জার্মানীর Mainz শহরে প্রথম ছাপানাে বই প্রকাশিত হয়। এই কাজের সাথে তিনজন ব্যক্তির নাম জড়িত ছিল। এদের মধ্যে অগ্রণী হলেন জোহান গুটেনবার্গ, জোহান ফাস্ট এবং পিটার সােফার। গুটেনবার্গের মুদ্রিত বাইবেলকে (১৪১৫ খ্রঃ) প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থের সম্মান দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকেরা এই বাইবেলকে ৪৮ লাইন বাইবেল বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রায়ই একই সময়ে প্রতি পৃষ্ঠায় ৩৬ লাইন সম্বলিত আরেকটি বাইবেল প্রকাশিত হয়েছিল। যাইহােক, এই গ্রন্থগুলির মুদ্রণ ও বাঁধাই ছিল পরিপাটি। নান্দনিক দিক থেকেও এগুলি ছিল তৃপ্তিদায়ক।

১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ছাপা বইগুলিকে বলা হত ইনকুনাবুলা। এগুলি দেখতে ছিল অবিকল পুঁথির মত। সম্ভবত, প্রকাশকের লক্ষ্য ছিল পুঁথির মত বই সৃষ্টি করে ক্রেতার মনােযােগ আকর্ষণ করা। তাছাড়া প্রথমদিকে ছাপা বই পুস্তকের বিষয়বস্তু ছিল মূলত ধর্মীয়। বাইবেলের সারাংশ, সন্তদের জীবনী ইত্যাদি ছিল আলােচ্য বিষয়। তাই পুঁথির অবয়বের সাথে মুদ্রিত পুস্তকের মিল রাখা হয়েছিল। ক্রমে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, নগরায়ণ, শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর আবির্ভাব, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যাচর্চা ও গ্রন্থের চাহিদা সৃষ্টি করে। এইভাবে ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, ইতিহাস, আইন ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের মুদ্রণ শুরু হয়।

অধ্যাপক Hayes লিখেছেন যে, মুদ্রণ বিপ্লবের প্রধান তাৎপর্য হল বহুগ্রন্থের প্রকাশ। বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ, গ্রীক পাঠ্যপুস্তক, অঙ্ক, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষাসাহিত্য ইত্যাদি বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে প্রকাশিত হয়। এই শতকের শেষ দুই দশকে ফ্রান্সের প্রায় ৪০টি শহরে ছাপার কাজ শুরু হয়। পঞ্চদশ শতকের শেষে ইউরােপের ২০০-এর বেশী শহরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়। মুদ্রণ বিপ্লবের প্রথম ৫০ বছরের প্রায় দেড় থেকে দুকোটি বই ছাপা হয়েছিল বলে Febvre এবং Martin মন্তব্য করেছেন। বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ প্রকাশিত হলে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার শিক্ষাব্যবস্থাকে মুষ্টিমেয় চার্চ ও Schoolman-দের একচেটিয়া আধিপত্য থেকে মুক্ত করে। ই. এফ. রাইস এবং এ. মাকটন বলেছেন, Printing freed the memory’ মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে স্মরণশক্তির অপরিহার্যতা শিথিল হয়। মুদ্রিত পুস্তক জ্ঞানভাণ্ডারকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। বৈজ্ঞানিক ও ভৌগােলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব দেখা দেয়। বিভিন্ন নতুন আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ব্রাহে, হার্ভে প্রমুখের বিজ্ঞান সাধনার কথা পৌছে যায় মানুষের কাছে। জীববিদ্যাকে চিত্ৰশােভিত করার কাজে এবং গ্লোব আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মুদ্রণ বিপ্লবের অবদান স্মরণীয়।

নিউ কেমব্রীজ মডার্ণ হিস্টরি :- গ্রন্থে বলা হয়েছে, মুদ্রণ মানুষের চিন্তার জগৎকে উন্মােচিত করে। অতঃপর সূক্ষ্ম বৌদ্ধিক আলােচনায় স্থান নেয় মানবতাবাদী সাহিত্য। ই.এফ.রাইস মনে করেন, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন। ঘটায়। বৌদ্ধিক কাজকর্ম-গােষ্ঠীবদ্ধতার গণ্ডী অতিক্রম করে গােটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন যেমন শ্রমক্ষমতা বাড়িয়েছিল তেমনি মুদ্রণের আবিষ্কার মানুষের মননক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অধ্যাপক রাইস আধুনিক যুগের কম্পিউটারের সাথে মুদ্রণবিপ্লবের তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, Printing acceleral the diffusion of images and ideas.

ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের ওপর মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। Fabver and Martin মনে করেন যে, ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন বই-এর নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। বই কেবল মানুষের মন পাল্টায়, বই থেকে নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে আস্থা আহরণ করা যায়। যাদের মনে নতুন বিশ্বাস জন্মেছিল মার্টিন লুথারের বিভিন্ন বই থেকে সেই বিশ্বাস সম্পর্কে উৎসাহ পেয়েছিলেন। আবার যাদের মধ্যে সংশয় ছিল তারাও নতুন দিশার সন্ধান পেয়েছিলেন। ছাপাখানার সাহায্যে লুথার ১৫১৭-২০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিরিশটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লেখা ২ লক্ষ কপি ইউরােপের নানাদেশে বিক্রি হয়। বাইবেলের মহান বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রেও মুদ্রণযন্ত্রের ভূমিকা স্মরণীয়। মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে স্থানীয় ভাষায় বাইবেল ছাপা হয়। সাধারণ মানুষ বাইবেলের মমার্থ অনুধাবন করে চার্চ ও যাজকদের প্রকৃত ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। ফলে ক্যাথলিক চার্চের মর্যাদা শিথিল হয়। কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। ফলে ক্যাথলিক চার্চের মর্যাদা শিথিল হয়। ক্ষুব্ধ চার্চ ষােড়শ শতকের শেষদিকে নিষিদ্ধ বই-এর তালিকা প্রকাশ করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে। রাজা অষ্টম হেনরী মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে রাজার বক্তব্য প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুদ্রিত পুস্তকের সাহায্যে তিনি ইংল্যাণ্ডে সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখক, মুদ্রক ও প্রকাশকের সঙ্গে ধর্মীয় ও সরকারী কর্তৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই আদর্শগত সংঘাতের পরিণতি ছিল আদর্শগত স্বাধীনতা—যা আধুনিক যুগের পরিচায়ক।

Leave a reply