Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

আধুনিকতার অগ্রদূত হিসাবে রাজা রামমােহন রায়ের কৃতিত্বের মূল্যায়ণ করাে।

 রাজা রামমােহন রায়ের কৃতিত্ব

রাজা রামমােহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত। সাধারণভাবে তাকে আধুনিক ভারতের জনক বলা হয়। এই অভিধার তাৎপর্য হল যে রামমােহন ভারতে আধুনিকতার সূচনা করেন এবং তিনিই মধ্যযুগীয় সমাজ থেকে আধুনিক ভারতের বিচ্ছেদ ঘটান। তার জীবনকালে আধুনিকতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি যথা যুক্তিবাদ, মানবিকতাবাদ, অর্থনৈতিক উদ্যোগ, কুসংস্কার বিরােধী মানসিকতা ফুটে উঠেছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাকে ভারতপথিক আখ্যা দিয়েছেন।

রাজা রামমােহন রায়ের জীবনী

১৭৭২ (মতান্তরে ১৭৭৪ খ্রঃ) ভারতবর্ষের একতমসাবৃতকালে রামমােহনের জন্ম। গ্রাম্য পাঠশালায় বাংলা বিদ্যাশিক্ষা করে রামমােহনকে পাটনায় যেতে হয় আরবী ও ফারসী শিক্ষার জন্য। এর কিছুদিন পরে কাশীধামে গিয়ে তিনি সংস্কৃত শিক্ষা করেন। পরে ইংরাজীও শিখেছিলেন এছাড়া উর্দু, হিব্রু, ফরাসী, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষাতেও ব্যুৎপত্তিলাভ করেছিলেন।

রাজা রামমােহন রায়ের ধর্মসংস্কার 

রামমােহনের জীবনের এক অনবদ্য কীর্তি ধর্মসংস্কার, প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব পৌত্তলিক হিন্দুধর্ম, নানা কুসংস্কার লােকাচার এবং পুরােহিততন্ত্রের স্বৈরাচারী ও মূঢ় আচরণে তিনি মর্মাহত হন। তার এই বিশ্বাস সুদৃঢ় হয় যে – হিন্দু সমাজের পতনের, মূল কারণ হল হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং তাদের অশাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান। ১৮০৩ খ্রীঃ বহুবাদের বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদের সমর্থনে ফারসি ভাষায় তিনি একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এই পুস্তিকার মাধ্যমে তিনি বহুদেববাদ পৌত্তলিকা, অলৌকিকত্ব ও অবতারবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানেন। এই পুস্তিকাটি হল—

তুহাফ-উল-মুয়াহিদ্দিন বা একেশ্বরবাদীদের প্রতি। ১৮১৪ খ্রীঃ কলকাতায় এসে তিনি উদার চিন্তাশীল ও সংস্কার প্রয়াসী কতিপয় ব্যাক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে আত্মীয় সভা স্থাপন করেন। এর দ্বারা তিনি কোনাে স্বতন্ত্র ধর্ম স্থাপন করেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আত্মসম্মানবােধী।তিনি খ্রীষ্টান পাদ্রীদের হিন্দু ধর্মের দেবদেবীদের নিয়ে ব্যঙ্গ পছন্দ করতেন না। তিনি আত্মীয়সভা ও ব্রাম্মসমাজ স্থাপন করে এই সত্যই পুনরায় প্রচার করলেন যে হিন্দুধর্ম কেবল পুতুল পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পরে তিনি বিরুদ্ধ একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে নিরাকার উপাসনা রীতি প্রচারের জন্য একটি নতুন প্রতিষ্ঠান করলেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটির নাম দেন ব্রায়সমাজ। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ব্রাক্মসমাজের নবনির্মিত উপাসনা গৃহস্থাপন করেন।

শিশুও বালিকার বিবাহ, কন্যা বিত্রি, সতীদাহ, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুসংস্কারগুলি দূর করবার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। সামাজিক সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম হল সতীদাহ প্রথা নিবারণ। তিনি বাংলা ও ইংরেজীতে পুস্তিকা ও সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করলেন যে শাস্ত্রানুসারে সহমরণ হিন্দু বিধবার অবশ্য কর্তব্য নয়। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড বেন্টিং কর্তৃক সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ হলে রামমােহন বহু হিন্দু নেতার স্বাক্ষর সম্বলিত এক পত্রে সরকারকে ধন্যবাদ জানান। পিতার ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকার করবার জন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না নারী জাতির এমন কল্যাণকামী সুহূদ বিরল।

রাজা রামমােহন রায়ের শিক্ষা সংস্কার 

রামমােহনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল শিক্ষা সংস্কারে তার নিরলস প্রয়াস। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তিনি ভারতের নবজাগরণের পথ সুগম করেন। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্টার সঙ্গে তিনি কতটা যুক্ত ছিলেন তা বিতর্কের বিষয় কিন্তু তিনি নিজ ব্যয়ে কলকাতায় একটি ইংরাজী বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। (১৮১৬ খ্রীঃ)। রামমােহন প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি বিদ্যালয় তার বেদান্ত কলেজ এবং এহেয়ারের বিদ্যালয়ে পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে লিখিত এক পত্রে তিনি ভারতবর্ষে গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, অস্থিবিদ্যা ও পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষা দেবার দাবি জানান। তার লিখিত এই পত্রটি ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে এক মূল্যবান দলিল। ১৮৩০ খ্রীঃ স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হলে রামমােহন ছিলেন তার প্রধান সহায়ক।

অর্থনৈতিক চিন্তা 

অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে রামমােহন পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি এদেশে কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার দেশীয় পণ্যের ওপর কোম্পানীর অধিক শুল্ক আরােপ এবং ভারতীয় সম্পদের নির্গমন বা Drain এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কৃষকদের উপর জমিদারদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। হাটে চাষীদের কাছে তােলা নেওয়া বন্ধ করবার জন্য তিনি আন্দোলন করেন। লবনের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে, তারই আন্দোলনের ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলা ভাষা 

বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমােহনের ভূমিকা খুবই উল্লেখযােগ্য। প্রকৃত অর্থে কোনও সাহিত্য গ্রন্থ রচনা না করলেও হিন্দুধর্মসংস্কার হিন্দু ধর্মসংস্কার ও একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু পুস্তিকা ও উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর বেদান্ত গ্রন্থ ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ অতি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। বঙ্গদূত, ব্রাত্মণ সেবধি, সম্বাদ কৌমুদী প্রভৃতি সংবাদপত্র মারফৎ তিনি বাংলা ভাষায় নির্মাণ কার্যে ব্রতী হন। তাঁর রচিত গৌড়ীয় ব্যাকরণ বাংলা ভাষায় বাঙালি লিখিত প্রথম ব্যাকরণ। ডঃ ত্রিপুরাশঙ্কর সেন বলেন যে, রামমােহনের রচনার বৈশিষ্ট্য হল – “চিন্তাধারার সুস্পষ্টতা অনাবশ্যক শব্দের বর্জন, উচ্ছ্বাসরাহিত্য, সুনির্বাচিত অর্থভূমিষ্ট শব্দের প্রয়ােগ।

রাজনৈতিক চিন্তাধারা 

রামমােহনকে আধুনিক চিন্তাধারার জনক বলা হয়ে থাকে। শাসনতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক অভিযােগ দূরীকরণের যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন তাকে অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৮২৭ সালে জুরী আইনের প্রতিবাদ করে তিনি খ্রীষ্টান প্রজাদের সাথে হিন্দু মুসলমান প্রজাদের আইনগত সুযােগ সুবিধার বৈষম্যের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি তদানীন্তন ইউরােপের রাজনৈতিক চিন্তাবিদ মন্তেষ্ক, রুশাে, ভলতেয়ার, টস পেইন, বেন্থাম প্রমুখের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে ভারতেরশাসন ভার কোম্পানীর হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার ও পালামেন্টের কাছে হস্তান্তরিত হােক। তিনি ক্ষমতা বিভাজন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের পৃথক অস্তিত্বের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। ডঃ বিপিনচন্দ্র বলেন, রামমােহন ভারতেনবজাগ্রত জাতীয়তাবােধের অন্যতম প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন।

মূল্যায়ণ 

রামমােহনের কৃতিত্বের মূল্যায়ণ নিয়ে পন্ডিত ও সুধী মহলে নানা পরস্পর বিরােধী মতামত প্রচলিত আছে। কিশােরীচাঁদ মিত্র, প্যারীচাদ মিত্র, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী সকলেই তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। রামমােহন ছিলেন সংস্কারক, বিপ্লবী নয়। তাই নিজ ধর্ম ও রীতিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন করতে তিনি পারেননি। তাছাড়া উপবীত বর্জন কিংবা অব্রাত্মণের হাতে খাদ্য গ্রহণ করলে তাকে ধর্মচ্যুত ঘােষণা করা রক্ষণশীলদের পক্ষে সহজ হত। সেক্ষেত্রে ধর্মের মধ্যে থেকে সমালােচনা করার সে সুযােগ ও শক্তি যা থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন। বিধর্মীয় সমালােচনা সত্য হলেও তার আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিত। তাই ধর্মের মধ্যে থেকেই তিনি। এর সংস্কার চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সালাউদ্দিন আহমেদ-এর বিশ্লেষণ স্মরণীয়। তিনি লিখেছেন – “He assumed the role of a cautious reformen rather than a militant revolutionary .. He did not believe in leading or creating a mass movement by openly defying established practices.”

Leave a reply