Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (১৮৪৮ খ্রি.) গুরুত্ব ও ফলাফল আলোচনা করো।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (১৮৪৮ খ্রি.) গুরুত্ব ও ফলাফল

উনিশ শতকে ফ্রান্স ছিল ইউরোপীয় বিপ্লবের পীঠস্থান। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সকেই নয়, সারা ইউরোপকেই টলিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপীয় বিপ্লবের ইতিহাসে ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের উৎসভূমি প্যারিস হলেও এর প্রভাব পড়েছিল ইউরোপের সমস্ত রাষ্ট্রে। তাই ঐতিহাসিক লজ্‌ বলেছেন—ফ্রান্সের বিপ্লবী চুল্লি থেকে স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে ইউরোপের সারহীন কাঠের স্তূপে আগুন জ্বালিয়েছিল।

ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব

ফ্রান্সে এই যুগান্তকারী ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব ছিল নিম্নরূপ—

(১) রাজতন্ত্রের অবসান—প্রজাতন্ত্রের জয়

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্রের জয় সূচিত হয়। প্রজাতন্ত্রী নেতা লা-মার্টিনের নেতৃত্বে ফ্রান্সে এক অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় (২৬ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ খ্রি.), যা দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত।

(২) সার্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পূর্বে সংস্কারপন্থী নেতৃবর্গ থিয়ার্স, লা-মার্টিন প্রমুখ সার্বজনীন ভেটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। কেননা বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সমগ্র অধিবাসীদের মধ্যে মাত্র ৩ লক্ষ মানুষ ভোটাধিকার পেয়েছিল। তাই বিপ্লবের পর দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সরকার ফ্রান্সের সকল নাগরিককে ভেটাাধিকার দিয়েছিল।

(৩) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন

সার্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতিলাভ ও তার প্রয়োগ ঘটিয়ে ৭৫০ জন সদস্যের এককক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভা গঠন এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল। এই আইনসভায় চার বছরের মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নীতি গৃহীত হয়।

(৪) নিম্নবিত্তদের ক্ষমতা লাভ

ফেব্রুযারি বিপ্লবের সবথেকে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ছিল এই যে, এই বিপ্লবের পরেই ফ্রান্সে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনশ্রেণির অবস্থার উন্নতি ঘটে। ভোটাধিকার লাভ করার পাশাপাশি এদের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটেছিল। প্রকৃত অর্থে এই বিপ্লবের মাধ্যমে নিম্নবুর্জোয়ারা উচ্চবুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ই. লিপসন বলেছেন—১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের দ্বারা উচ্চ-বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্ষমতা নিম্নবুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়।

(৫) দাস প্রথা উচ্ছেদ

ফ্রেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সরকার দাসপ্রথার উচ্ছেদ ঘটায়। এর ফলে প্রায় ৫ লক্ষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার অধিকার ফিরে পায়।

(৬) জনকল্যাণকামী শাসন প্রবর্তন

প্রজাতান্ত্রিক সরকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারসাধনের মাধ্যমে জনকল্যাণকামী শাসন প্রবর্তন করে। (১) শ্রমিক সমস্যার সুরাহার লক্ষ্যে লুই ব্লাঙ্কের নেতৃত্বে লাক্সেমবার্গ রাজপ্রাসাদে এক স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠন করা হয়। (২) ফ্রান্সের প্রত্যেক অধিবাসীর ‘কাজ পাওয়ার অধিকার’ স্বীকৃতি পায়। (৩) বেকারসমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্যারিসে ‘জাতীয় কর্মশালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ইউরোপের অন্যত্র ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল

মেটারনিখ একবার মন্তব্য করেছিলেন— ‘When France catches cold, Europe sneezes’ অর্থাৎ ফ্রান্সের যখন ঠান্ডা লাগে, সমগ্র ইউরোপই তখন সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হয়। মন্তব্যটি যে কতদূর সার্থক ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলশ্রুতিই তা প্রমাণ করে। এর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সারা ইউরোপে দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের ১৫টি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে। তাই ডেভিড টমসন বলেছেন— ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ জনতার যুগের সূচনা করে।

(১) জার্মানিতে

জার্মানিতে বিপ্লবের ভাবধারা এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার সঞ্চার করে। প্রাশিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক গণ আন্দোলন তীব্রতর হয়। ফ্রাঙ্কফোর্টে জার্মানির জাতীয়াবাদীদের সমাবেশে প্রাশিয়ারাজ চতুর্থ ফ্রেডারিক উইলিয়মকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাটপদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়।

(২) ইতালিতে

ইতালির পার্মা, মোডেনা, মিলান, ভেনিস, টাস্কনি, সিসিলি, নেপল্স, এমনকি পোপের রাজ্যেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। সার্ডিনিয়ারাজ চার্লস্ অ্যালবার্ট তাঁর রাজ্যে একটি উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। লম্বার্ডি ভেনেসিয়া ও মিলানের অধিবাসীরা অস্ট্রিয়-বাহিনীকে বিতাড়িত করে। ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৩) অস্ট্রিয়াতে

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে অস্ট্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভিয়েনা, হাঙ্গেরি—সর্বত্র বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। ভিয়েনাম মেটারনিখের বাসভবন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। ভীত মেটারনিখ আত্মরক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলে মেটারনিখতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। অস্ট্রিয়ার সম্রাট একটি উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তন বাধ্য হয়। মেটারনিখতন্ত্রের পতনের পর ‘লন্ডন টাইমস্‌’ পত্রিকায় লেখা হয়—পুরাতনতন্ত্রের শেষ রশ্মি আজ নিভে গেল।

(৪) হাঙ্গেরিতে

অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যভুক্ত হাঙ্গেরিতেও জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়। উত্তর হাঙ্গেরির মডিয়ার গোষ্ঠীর অধিবাসীরা লুই কসুথের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। হ্যাপসবার্গ সম্রাট সাংবিধানিক শাসক মনোনীত হন। এদিকে দক্ষিণ হাঙ্গেরি (পরে যুগোশ্লাভিয়া)-তেও ক্রোট ও সার্ব জাতি জোেসফ জেলাকিকের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

(৫) অন্যান্য রাষ্ট্রে

বোহেমিয়ায় চেক ও স্লাভ জাতীয়বাদীরা তাদের দাবি আদায় করে নেয়। বেলজিয়াম, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, এমনকি ইংল্যান্ডেও গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি এই বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত হয়।

উপসংহার

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সাফল্যের স্থায়িত্ব খুব বেশিদিন ছিল না। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে অস্ট্রিয়া প্রতি আক্রমণ শুরু করে। যার আঘাতে ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভেঙে পড়ে। তবু দীর্ঘকালীন ফলাফলের বিচারে বলা যায় ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে যে গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার অর্জনের লড়াই শুরু হয়েছিল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে তা সম্পূর্ণতা পায়।

Leave a reply