Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

ভারতের নগরায়ণের উদ্ভবের কারণগুলি বিশ্লেষণ কর?

ভারতের নগরায়ণের উদ্ভবের কারণ

ভূমিকা

হরপ্পা শহরগুলির পতনের প্রায় হাজার বছর পর দ্বিতীয়বার ভারতে নগরায়ণের সূচনা হল। সাধারণত, শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র হিসাবে এক একটি স্থান নগররূপে আত্মপ্রকাশ করে। নগরে চাষ আবাদ হয় না, খাদ্যের জন্য নগরকে গ্রামের কৃষিজ উদবৃত্তের উপর নির্ভর করতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজতন্ত্র উত্তরোত্তর শক্তিশালী হতে থাকে। রাজশক্তি তার আমলা ও সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ এবং স্বার্থে উদ্বৃত্তের উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দেয়। এই উদবৃত্তের একটা অংশ রাজা রাজস্বরূপে গ্রহণ করতেন, বাকি অংশ বেসামরিক নগরবাসীর প্রয়োজন মেটাত। এই কৃষিজ উবৃত্তের সংস্থান না থাকলে নগরের অভ্যুদয়ের পথটিই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ত।

কৃষির উন্নতি

একটি শহরের অভ্যুত্থানের পিছনে এক বা একাধিক কারণ বর্তমান থাকে। কৃষিজ উদবৃত্তের সংস্থান নগর উদ্ভবের একটি প্রধান কারণ। শহরের লোকেরা সাধারণত সরাসরি খাদ্যোৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। তাঁরা কারিগরি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, এবং সরকারি-বেসরকারি নানা বৃত্তিতে লিপ্ত থাকেন। শহরে খাদ্যের যোগান নিয়মিত ও পর্যাপ্ত হলে তবেই শহরবাসীদের পক্ষে এ ধরনের জীবিকা গ্রহণ সম্ভব হয়। গ্রামাঞ্চলে ফসলের ফলন উদবৃত্ত হলে সেই উদবৃত্ত খাদ্যশস্য শহরবাসীদের চাহিদা পূরণ করে। সেই প্রাচীন যুগে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল তখন খাদ্যশস্যের সমৃদ্ধ গ্রামগুলিরই সন্নিকটে শহর গড়ে উঠত। শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির মধ্যে ছিল এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গ্রাম শহরকে যোগাতো খাদ্য আর কাঁচামাল, বিনিময়ে পেত শহরজাত শিল্পসামগ্রী ও প্রাত্যহিক জীবনের নানা উপকরণ। সন্দেহ নেই কৃষির বিকাশে নগরায়ণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।

প্রশাসনিক গুরুত্ব 

প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক গুরুত্ব নগর-উদ্ভবের অবশ্যই একটি কারণ। রাজার বসতি স্থাপন স্বাভাবিক কারণে রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাসস্থানরূপে গড়ে ওঠে এবং সৈন্যবাহিনীর আবাসস্থলরূপেও পরিগণিত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পুরণের জন্য স্থানটিতে কারিগরি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিকাশলাভ করে। রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে রাজধানী হতে সমগ্র রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করা দুরূহ হয়, তখন কয়েকটি স্থান প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, রাজগৃহ ও শ্রাবন্তীর মতো সমৃদ্ধশালী শহরগুলির অভ্যুত্থানের মূলে ছিল এই রাজনৈতিক গুরুত্ব। উল্লিখিত প্রতিটি শহর ছিল কোনও না কোনও মহাজনপদের রাজধানী।

কারিগরি শিল্পের বিকাশ

কারিগরি শিল্পে বিকাশ নগর অভ্যুত্থানের আর একটি কারণ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে উত্তর-ভারতে কারিগরি শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি হয়। উন্নতি ঘটে শিল্পের বৈচিত্র্যে ও প্রসারে এবং উৎপাদনের পরিমাণে। জাতক সাহিত্যে আঠারো রকম শিল্পের উল্লেখ আছে। দীর্ঘনিকায়ে শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে আঠাশে গিয়ে পৌঁছেছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে বার বার ‘শিল্প’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ সময় লোহা, তামা ও রূপার ব্যবহার উল্লেখজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। মৃৎশিল্পও উল্লেখজনকভাবে বিকাশ লাভ করে। এ সময় কৃষ্ণ-লোহিত ও উদীচ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র নির্মিত হতে থাকে। পাত্রগুলি অনেক উন্নত। এক প্রাচীন পালিগ্রন্থে সন্দালপুত্ত নামে বৈশালীর এক বর্ধিষ্ণু কুম্ভকারের কথা বলা হয়েছে যিনি পাঁচশো মৃৎশিল্পীকে তাঁর কারখানায় নিয়োগ করেছিলেন।

শিল্পের আবশ্যক কাঁচামাল যেখানে সহজলভ্য অথচ শিল্পজাত সামগ্রীর বিক্রয়ের সুবিধা আছে এমন স্থানেই শিল্পীরা তাঁদের বসতি নির্বাচন করেন। প্রথমে হয়তো তাঁরা অল্পবিস্তর কৃষির কাজও করতেন কিন্তু যতই শিল্পজাত সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং উন্নতর কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, ততই তাঁরা শিল্পকর্মের দিকে বেশি করে আকৃষ্ট হন এবং কৃষিকর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এভাবে এক একটি স্থানে বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে। শিল্প সংগঠনও তৈরি হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সেস্থান আর গ্রাম থাকে না, স্বভাবতই নগরে পরিণতি লাভ করে।

ব্যবসা বাণ্যিজের উন্নতি

ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি নগরের সৃষ্টির আর একটি কারণ ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ পঞ্চম শতকে কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। বহু লোক ‘বণিজ্জা’ বা বাণিজ্যকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন। শকটে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যাদি সাজিয়ে বণিকের দল স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন করতেন। অশ্ব ও গো-বণিকেরা জীব-জন্তুর ব্যবসা করতেন। বাণিজ্যোপজীবীরা যাতায়াত করতেন স্থলপথে, কখনও বা নদীপথে। ফলে বণিকদের যাতায়াতের পথের ধারে, নদীতটে, কখনও বা নদী বা পথের সঙ্গমস্থলে বিপণন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বিপণন কেন্দ্রগুলি উত্তরোত্তর সমৃদ্ধশালি হয় এবং শহরের রূপ ধারণ করে।

বুদ্ধদেব বা বিখ্যাত ব্যক্তি আগমনের ফল

দুই মন্ত্রী সুনীধ ও বর্ষকারের আমন্ত্রণে সশিষ্য বুদ্ধদেব পাটলিগ্রাম পরিদর্শনে আসেন। পাটলিগ্রাম তখনও ‘নগরের পত্তন হয় নাই’, সবেমাত্র সেখানে একটি দুর্গ নির্মিত হয়েছে। তিন তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্তিত এই স্থানটির অবস্থানগত গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। তিন তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই স্থানটি সড়কযোগে উত্তর ভারতের বিখ্যাত অঞ্চলগুলির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। স্থানটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে বুদ্ধদেবের দেরি হয়নি। তিনি ঘোষণা করেন, স্থানটি অচিরে পুটভেদনরূপে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ভারতের এক শ্রেষ্ঠ নগরে পরিণত হবে। শীঘ্রই পাটলিগ্রাম মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানটির নতুন নামকরণ হয় পাটলিপুত্র।

ধর্মীয় কারণের ফলে

ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে কোনও কোনও স্থান নগরে পরিণত হয়। মহাবীর ও বুদ্ধদেবের স্মৃতি-বিজড়িত বিভিন্ন স্থান জৈন ও বৌদ্ধদেব নিকট ছিল পবিত্র ভূমি ও তীর্থক্ষেত্রে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধার্মিক ব্যক্তিরা এসব স্থান দর্শন করে ধন্য হতেন, পুণ্য অর্জন করতেন। সারা বছরই এখানে তীর্থযাত্রীদের সমাগম হত। পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য তীর্থস্থানে বিভিন্ন ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এতে বহুলোকের কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হয়। এসব স্থান ধীরে ধীরে শহরের রূপ নেয়। এভাবেই কুশীনগর, কপিলাবস্তু, সারনাথ, শ্রাবন্তী, বৈশালী, বোধগয়া প্রভৃতিকে শহরের উদ্ভব হয়।

রাজাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ

বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র এমন স্থানও কখনও কখনও নগররূপে আত্মপ্রকাশ করে। তক্ষশিলা শহরের উদ্ভবের এটিই মুখ্য কারণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে চর্চা হত এখানে। বারাণসী, রাজগৃহ, উজ্জয়িনী, মিথিলা প্রভৃতি দূরবর্তী স্থান হতে বিধ্যার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এখানে আসতেন। অনেক পরবর্তিকালের দুটি শহর নালন্দা ও বিক্রমশীলা জ্ঞান চর্চার পীঠস্থানরূপেই শহর দুটি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল।

উপসংহার

শহরের উদ্ভব সম্পর্কে একটি কথা মনে রাখতে হবে। কখনও কখনও শহরের অভ্যুত্থানের মূলে একটি নয়, একাধিক কারণ বর্তমান থাকে। এ প্রসঙ্গে তক্ষশিলা নগরের কথা উল্লেখ করা যায়। শহরটি বিদ্যাচর্চার এক পীঠস্থান ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু শহরটির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও কম ছিল না। অর্থাৎ শুধু শিক্ষাজনিত কারণেই তক্ষশিলার উদ্ভব হয়নি স্থানটির নগরে উত্তরণের মূলে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মাহাত্ম্যও সমানভাবে কাজ করেছিল।

Leave a reply