Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

আফিম যুদ্ধের ক্ষেত্রে আফিম কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ? এক্ষেত্রে কমিশনার লিন এর ভূমিকা আলোচনা কর।

সপ্তম ও অষ্টম শতকে চিনে আফিমের প্রচলন করেছিলেন তুর্কি এবং আরব বণিকেরা। কিন্তু চিনারা ওষুধ হিসাবে আফিমের ব্যবহার করতেন, নেশার জিনিস হিসাবে আফিমের ব্যবহার তাদের কাছে সম্পূর্ণ আজানা ছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চিনে আফিমের ব্যবহার মারাত্মক রকম বেড়ে গিয়েছিল। ফলে চিনে আফিমের চাহিদারও বৃদ্ধি ঘটেছিল। হঠাৎ কেন চিনের মানুষ আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে আরম্ভ করলেন এবং আফিমের চাহিদা চিনে বাড়িয়ে দিলেন? এর একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে।

ইংল্যান্ড রুদ্ধদ্বার চিনকে উন্মুক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। তাকে মদত দিয়েছিল অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। ইংল্যান্ড উঠেপড়ে লেগেছিল। তাকে মদত দিয়েছিল অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। ইংল্যান্ড চিনের সাথে একটি বাণিজ্যিক ভারসাম্য (Balance of Trade) গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সহ অন্যান্য পাশ্চাত্য বণিকরা সকলেই চীনের থেকে দ্রব্য ক্রয় করে রৌপ্যের মাধ্যমে তার দাম মেটাত। কিন্তু পাশ্চাত্য বণিকদের কাছে বিষয়টি লাভজনক ছিল না। তাঁরা তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে দ্রব্য ক্রয় করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চীনারা কখনোই পশ্চিমি পণ্য ক্রয় করতে আগ্রহী ছিল না, যেহেতু তাদের নিজের দেশে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হত। সুতরাং চিনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখার জন্য ও চিন থেকে পণ্য ক্রয় করে রপ্তানির জন্য, পশ্চিমি বণিকদের রৌপ্য দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

কিন্তু ব্রিটিশ ও আমেরিকান বণিকেরা নিজেদের লাভের মাত্রা বাড়ানোর জন্য এক অভিনব উপায় বের করলেন। তাঁরা চিনের অভ্যন্তরে আফিম চোরাই চালান করতে লাগলেন। এই চোরাই চালান আরম্ভ হয়েছিল ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। ইংরেজ বণিকেরা অত্যন্ত সস্তায় আফিম ক্রয় করতেন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারতবর্ষের বাংলাদেশ থেকে। আমেরিকান বণিকেরা কিনতেন তুরস্ক থেকে। আফিমের চোরাই পাচারের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চিনের মানুষ আফিমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লেন। চিনে আফিমের বেআইনি ব্যবসা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে লাগল। আফিম গ্রহণ করার পরিবর্তে চিনারা ইংরেজ বণিকদের চা, রেশম, চিনামাটির বাসন (Porcelain) ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী দিতে লাগলেন। কিন্তু আফিমের চাহিদা চিনে এত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে লাগল যে, এত সব জিনিস দিয়েও বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হল না। তখন চিনারা রৌপ্য দিয়ে আফিম ক্রয় করতে লাগলেন। কিছুদিন আগেও চিনা বণিকেরা রূপার বিনিময়ে নিজের দেশের পণ্যসামগ্রী বিদেশি বণিকদের কাছে বিক্রি করত। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে আফিম আমদানি করতে গিয়ে তাদের নিজের দেশের রৌপ্য বিদেশে চলে যেতে লাগল। বিদেশি বণিকদের দ্বারা চিনে আফিম পাচারের ফলে একদিকে নেশায় আসক্ত চিনাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটল, অন্যদিকে চিনের অর্থনীতি যৎপরোনাস্তি ক্ষতিগ্রস্ত হল।

কিছুদিনের মধ্যেই মাঞ্জু সরকার বেআইনি আফিম ব্যবসার মারাত্মক কুফলের কথা উপলব্ধি করল। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন চিন সম্রাট চিয়া চিং চিনে আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু ততদিনে প্রচুর সংখ্যা চিনা আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং অসংখ্য ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজকর্মাচারী এই অনৈতিক ব্যবসার সাথে নিজেদের যুক্ত করে বিরাট পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ফলে এই নিষিদ্ধকরণ চিনে আফিমের প্রবেশ বন্ধ করতে পারল না। চোরাই চালান এবং উৎকোচ আফিম ব্যবসার নিষিদ্ধকরণকে অর্থহীন প্রতিপন্ন করেছিল। চিনে বেআইনি আফিম ব্যবসা অপ্রতিহত গতিতে চলতে লাগল। একটি পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নিষিদ্ধকরণের পর চিনে আফিমের আমদানি আরও অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চিন ৩৮ মিলিয়ন স্পেনীয় ডলার রৌপ্যের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনের সমগ্র আদানিকৃত পণ্যের মধ্যে শতকরা ৫৭ ভাগ ছিল আফিম। চিনের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। এই পঙ্গু অর্থনীতির চাপ এসে পড়েছিল মূলত কৃষকশ্রেণীর উপর। প্রচুর পরিমাণে রৌপ্য দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে, কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস পেতে আরম্ভ করেছিল। অন্যদিকে ভূস্বামী এবং কর আদায়কারীরা নিজেদের আয় এবং জীবনযাত্রার মান যাতে নীচে না নামে, সেই জন্য কৃষকদের থেকে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দিল। ফলে চিনের সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে এক নয়া সংকট দেখা দিল। এই সংকটের ফলশ্রুতি হিসাবে চিনে কৃষক বিদ্রোহের এক নতুন আবর্তের আবির্ভাব ঘটল। মাঞ্জু সরকার বিরোধী অভ্যুত্থান ঘন ঘন হতে লাগল ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে একদল বিদ্রোহী পিকিং-এর রাজদরবার আক্রমণ করেছিল।

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্যান্টন অঞ্চলে বিদেশি বণিক এবং চিনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটেছিল। মাঝেমধ্যেই দুপক্ষ ছোটখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হত। সাধারণত বকেয়া ঋণ এবং চিনাদের বিচারব্যবস্থা নিয়েই ঝামেলা হত। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার লর্ড নেপিয়ার নামে জনৈকি প্রতিনিধিকে চিনে পাঠায়। নেপিয়ার ব্রিটিশ সরকার লর্ড নেপিয়ার নামে জনৈক প্রতিনিধিকে চিনে পাঠায়। নেপিয়ার ব্রিটিশ সংস্থাগুলিকে অন্যান্য বিদেশি সংস্থার থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য ক্যান্টন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু নেপিয়ারের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।

১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ বিশেষ কমিশনার হিসাবে ক্যান্ট পদার্পণ করেন ৫৪ বছর বয়সী লিন-সে-সু । তিনি রেআইনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। কমিশনার লিন ছিলেন পুরোনো চিনের একজন দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিত্ব। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি চু-জেন এবং ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে চিন-শি ডিগ্রি লাভ করেন। বিভিন্ন দায়িত্বশীল সরকারি পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। হানলিন অ্যাকাডেমির প্রবন্ধক, উন্নান প্রাদেশিক পরীক্ষার আধিকারিক, চেকিয়াং এর সার্কিট প্রধান ও লবণ নিয়ামক, কিয়াংশুর বিচারবিভাগীয় ও অর্থনৈতিক কমিশনার, হু-কোয়াং এর গভর্নর জেনারেল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে অলঙ্কৃত করেছিলেন। ৫৪ বছর বয়সে তিনি সাম্রাজ্যিক কমিশনার পদে উন্নীত হন। লিন তাঁর স্পষ্টবাদিতা, সততা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এই সমস্ত গুণাবলীর জন্য তাঁকে বলা হত “ইলন নীল আকাশ” (Lin the blue sky)। অর্থাৎ তাঁর চরিত্র ছিল। নীল আকাশের মতোই নির্মল ও পরিচ্ছন্ন।

ক্যান্টনের বিশেষ কমিশনার পদের দায়িত্ব গ্রহণের পর লিন উয়ে-হুয়া অক্যাডেমিতে তাঁর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। লিন -সে-সু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে আফিম সমস্যার সমাধান না করে তিনি ক্যান্টন পরিত্যাগ করবেন না। বেআইনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার সমস্যা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। লিন জানতেন চীনে আফিম ব্যবসা বন্ধ করার অর্থ পাশ্চাত্যের বিশেষত ইংল্যান্ডের বণিকদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়া। ব্রিটেনের মর্যাদা ও ক্ষমতা সম্পর্কেও তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। তথাপি যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও লিন চিনে আফিম ব্যবসা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। প্রথমে তিনি অসৎ চিনা আফিম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন, এবং এই প্রচার বেশ সাফল্য লাভ করেছিল। ১৮৩৯ সালের ১২ মে’র মধ্যে প্রায় ১৬০০ আইন লঙ্ঘনকারী অসৎ চিনা আফিম ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রচুর পরিমাণ আফিম সরকার তাদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে নেয়। অবৈধ আফিম বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত অসৎ রাজকর্মচারীদের কঠোর শাস্তি দিতেও কুণ্ঠিত হননি লিন।

১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ লিন বেআইন আফিম ব্যবসা বন্ধ করার ও মুসুদ্দি ও ভৃত্যদের আফিম বাণিজ্যের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য ব্রিটিশ কুঠি বা ফ্যাক্টরিগুলি অবরোধ করার নির্দেশ দেন। প্রায় ৩৫০ জন বিদেশি এই অবরোধের জন্য ফ্যাক্টরি চত্বরে আটক হয়ে রইলেন। খাদ্য ও কাজের লোকের অভাবে বিদেশিরা বিস্তর অসুবিধার সম্মুখীন হলেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইংরেজ বণিকদের কাছে গচ্ছিত যাবতীয় আফিম লিন তাঁর হেফাজতে সমর্পণ কররে নির্দেশ দেন। পরিস্থিতির চাপে বিদেশি বণিকরা প্রায় ২১,০০০ পেটি আফিম লিনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন লিন জনসমক্ষে এই বিপুল পরিমাণ আফিম ধ্বংস করেন। এই ঘটনায় ইংরেজ বণিকরা অপমানিত বোধ করেন এবং প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত হন।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আর একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই ক্যান্টন-ম্যকাও অঞ্চলে এক চীনা গ্রামবাসী কৃষক কাউলুনের একদল ব্রিটিশ নাবিকদের দ্বারা নিহত হন। তৎক্ষণাৎ লিন অপরাধীদের চিনা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্রিটিশ বণিকদের তদানীন্তন প্রতিনিধি এলিয়ট এই নির্দেশের বিরোধিতা করেন। তিনি জানিয়ে দেন, যে ব্রিটিশ প্রজাদের বিচার করার কোনো আইনগত এক্তিয়ার চিনা কর্তৃপক্ষের নেই। এলিয়ট নিজেই অপরাধীদের বিচার করেন। এই বিচার প্রহসনে পরিণত হয় এবং হত্যাকারীরা অত্যন্ত লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এলিয়টের অসহযোগিতা লিন-কে ক্ষুদ্ধ করেছিল। লিন পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষকে ব্রিটিশদের ম্যাকাও থেকে বহিষ্কৃত করার জন্য চাপ দেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট সমস্ত ব্রিটিশ প্রজা ক্যান্টন থেকে ৯০ মাই দূরে হংকং এ চলে যান। কমিশনার লিন বিজয়রীর মতো ম্যাকাওতে প্রবেশ করেন। ইম্যানুয়েল সু বলেছেন, এই সময় পর্যন্ত ইহগ-চিন বিরোধের প্রতিটি স্তরেই লিন জয়লাভ করেছিলেন।

Leave a reply