Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোচনায় অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা

উনিশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার জন্য প্রধানত যে-দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হত, তা হল নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু বিশ শতকের প্রথমদিক থেকে, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallas), ভি.ও. কী (V.O. Key), ডেভিড ট্রুম্যান (David Truman), হারবার্ট সাইমন (Herbert Simon), গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (Gabriel A. Almond), ডেভিড ইস্টন (David Easton), হ্যারল্ড লাসওয়েল (Harold Lasswell), সিডনি ভার্বা (Sidney Verba), কার্ল ডয়েস (Karl Deutsch), জি. বি. পাওয়েল (G. B. Powell), রবার্ট ডাল (Robert Dahl) প্রমুখ। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সাবেকি নীতিমানবাচক পদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচারবিশ্লেষণ করার জন্য অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে থাকেন। এর ফলে স্বাভাবিক কারণেই নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট পরিমানে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ 

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলতে রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার সেই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়, যা মূল্যমান নিরপেক্ষভাবে ভৌতবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সংহতি সাধনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা বিষয়গত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মতভাবে রাজনৈতিক তত্ত্ব রচনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হল রাজনীতির একটি অভিজ্ঞতাবাদী বিজ্ঞান (an empirical science of politics) গড়ে তোলা। সেজন্য তাঁরা সম্পূর্ণ মূল্যমান-নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনৈতিক আচরণকে বস্তুগতভাবে বিশ্লেষণ করেন।

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য

নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি হল অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এরুপ দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলি হল:

[১] মূল্যমান নিরপেক্ষ আলোচনা

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা, বিশেষত আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আলোচনা করার সময় নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ প্রভৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে যে-কোনো ঘটনার বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণের ওপর বিশেষ জোর দেন। তাঁরা ‘যা আছে’ (What is), অর্থাৎ ‘প্রকৃত অবস্থা’ (fact)-কেই বিচারবিশ্লেষণ করেন। তাঁদের মতে, রাজনীতি যদি একটি বিজ্ঞান হয়, তাহলে তার আলোচনা ও বিশ্লেষণকে অতি অবশ্যই মূল্যমান-নিরপেক্ষ হতে হবে। যে-কোনো পরিস্থিতি নিয়ে যে-বিবৃতি প্রদান করা হবে, তাকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণভিত্তিক হতে হবে এবং বারংবার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার সত্যতা বা যাথার্থ্য প্রমাণ করা সম্ভব। অভিজ্ঞতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা মনে করেন যে, নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কখনোই এরূপ করা সম্ভব নয়। তাই নৈতিক নীতি বা আদর্শ (moral principles or ideal) কিংবা কর্তব্যবোধ (sense of duty)-এর ওপর ভিত্তি করে কোনো বাস্তবসম্মত বা বিজ্ঞানসম্মত বিবৃতিই প্রদান করা সম্ভব নয়।

[২] বিষয়গত প্ৰকৃতি

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর বিষয়গত প্রকৃতি (Objective nature)। তাই স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায় প্রভৃতির মতো বিষয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রদানকারীদের মধ্যে কতকগুলি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে যুক্তি ও প্রতি-যুক্তি (arguments and counter-arguments)-র মাধ্যমে বিষয়গত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। এর মধ্যে ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের কোনো প্রশ্নই আসে না।

[৩] আরোহী পদ্ধতি অনুসরণ

রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার সাবেকি নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণকারী আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আরোহী পদ্ধতি (inductive method) অনুসরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সংহতি সাধণের জন্য তাঁরা তথ্য সংগ্রহ, পরিমাপ, সংখ্যায়ন, পর্যালোচনা প্রভৃতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। এইভাবে সঞ্চিত বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষানিরীক্ষার ভিত্তিতে তাঁরা রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আলোচনা করার পক্ষপাতী হওয়ার ফলে কোনো পূর্বানুমানকে অভ্রান্ত বা সত্য বলে মেনে নিতে রাজি নন। এরূপ ক্ষেত্রে আরোহী পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে তাঁরা সত্যে উপনীত হওয়ার পক্ষপাতী।

[৪] বর্ণনাকেন্দ্রিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল প্রকৃতিগতভাবে মূলত বর্ণনাকেন্দ্রিক (descriptive)। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা সেইসব নিয়ম বা সূত্র আবিষ্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যেগুলি মূলত অপরিবর্তনীয় বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি-সংক্রান্ত নিয়ম বা সূত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, এরূপ নিয়ম বা সূত্র মানুষের নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়, অর্থাৎ মানুষ নিজের ইচ্ছামতো তার কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। মানুষ কেবল এরূপ নিয়ম বা সূত্রকে অবিষ্কার করতে এবং তার বর্ণনা প্রদান করতে পারে।

তাছাড়া, এরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির বর্ণনাকেন্দ্রিক আলোচনার পর সে বিষয়ে পথনির্দেশ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা স্বাস্থ্য, পরিসেবা ও রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষার মতো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে একথা মনে হতে পারে যে, নীতিমানবাচক এবং অভিজ্ঞতাবাদী উভয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রথমে সমস্যা বা বিষয়ের বর্ণনা করার পর সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য পথনির্দেশ করা হয়। সুতরাং তাদের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। কিন্তু একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে উভয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই পার্থক্যটি হল—নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা যে-কোনো বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মূল্যমান-নিরপেক্ষ হওয়ার পরিবর্তে সমালোচনাধর্মী (critical) বর্ণনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁদের পূর্বানুমানের যাথার্থ্য প্রমাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, অর্থাৎ ‘যা আছে, তা নিয়েই আলোচনা করেন বলে তাঁদের আলোচনা মূল্যমান-নিরপেক্ষ অর্থাৎ বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে থাকে।

[৫] বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে এই যুক্তিতে সমালোচনা করেন যে, কোনোকিছু নীতিগতভাবে ভুল, না ঠিক, তা নির্ধারণের কোনো বিশ্বাসযোগ্য (reliable) বা বিজ্ঞানসম্মত (scientific) পদ্ধতি তাঁরা অনুসরণ করেন না। এর ফলে তাঁদের আলোচনা কখনোই বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাই তাঁদের অনুসৃত দৃষ্টিভঙ্গি যতই উচ্চতর ও নিম্নতর মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করুক না কেন, তা কখনোই বিজ্ঞানসম্মত নয়। সুতরাং বলা যায়, অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা সচেতনভাবেই উচ্চতর ও নিম্নতর মূল্যবোধের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নিরূপণ করেন না। কারণ, যে কোনো ধরনের মূল্যবোধযুক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না বলেই তাঁরা মনে করেন।

Leave a reply