Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি লেখো।

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্ত

গণতন্ত্র হল জনমতচালিত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রে জনগণকে সার্বভৌম শক্তির আধার বলে মনে করা হয়। গণতন্ত্রে সমগ্র শাসনব্যবস্থার মূল উৎস হল জনগণ। রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে গণতন্ত্র সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। গণতন্ত্র একটি উন্নততর শাসনব্যবস্থারূপে পরিগণিত হলেও এর সাফল্যের জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ আবশ্যক হয়ে পড়ে।

১) মিলের তিনটি শর্ত

জন স্টুয়ার্ট মিলের অভিমত অনুযায়ী, গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। সেগুলি হল—

  1. জনগণের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য,
  2. গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য নিজ নিজ কর্তব্য পালন ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য,
  3. গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অপরিহার্য কার্য সম্পাদনে জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য।

২) সুনাগরিক

সুনাগরিক ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। কিন্তু সুনাগরিকতার পথে প্রধান বাধা হল নির্লিপ্ততা ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা । গণতান্ত্রিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে ওইসব বাধা দূর করে এমন নাগরিক গড়ে তুলতে হবে যে নিজ স্বার্থ অপেক্ষা দেশের স্বার্থকে বড়ো করে দেখবে।

৩) গণতান্ত্রিক পরিবেশ

গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হল গণতান্ত্রিক পরিবেশ । গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয়। গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যে উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।

৪) লিখিত সংবিধান

অনেকে গণতন্ত্রের সফলতার জন্যে লিখিত সংবিধান আব্যশিক বলে মনে করেন। সংবিধান লিখিত হলে নাগরিকগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে এবং সরকারের ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। ফলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না।

৫) অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা

অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি স্বীকৃত হলে গণতন্ত্রের সাফল্য আসে না, তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। তাঁর ভাষায়, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ব্যতিরেকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। যে সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে, যেখানে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণাধীন, সেখানে জনগণ কখনও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে পারে না। অর্থনৈতিক সাম্য এবং জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গণতন্ত্রের সাফল্যের সহায়ক হিসাবে কাজ করে।

৬) শিক্ষার ব্যাপক প্রসার

শিক্ষার ব্যাপক প্রসারকে গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। এক্ষেত্রে অধিকাংশ জনগণ যদি অশিক্ষিত থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল এই কারণে মন্তব্য করেছেন যে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতির পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন । এই শিক্ষা হবে যথার্থ নাগরিকতার জন্য শিক্ষা।

৭) পরমত সহিঞ্চুতা

পরমত সহিয়ুতা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। গণতন্ত্রে জনগণের বাক্ ও মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে যার ফলে বহুমতের সৃষ্টি হয়। সেজন্য এখানে পরস্পরবিরোধী মতাবলম্বী ব্যক্তিদের মধ্যে সহিয়ু মনোভাব থাকা প্রয়োজন । জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মনোভাব থাকলে তা গণতন্ত্রের সাফল্যের পক্ষে সহায়ক হয়। গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মতামতকে যথাযোগ্য মূল্য দেওয়া সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এই পরমত সহিয়ুতা না থাকলে গণতন্ত্র সফল হয় না।

৮) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

গণতন্ত্রকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সাহায্যে জনগণ আরও সক্রিয়ভাবে প্রশাসনিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। অধ্যাপক ব্রাইস বলেছেন, গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ
বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

৯) দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ সরকারি কর্মী

গণতন্ত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকলেও বাস্তবে স্থায়ী সরকারি কর্মচারীরা প্রশাসন পরিচালনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। এসমস্ত কর্মচারীদের ওপর জনগণ এবং জনপ্রতিনিধি উভয়কেই নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা সৎ, সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ না হলে গণতান্ত্রিক সরকার তার ঈন্সিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে না।

১০) নেতৃবৃন্দের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুমপিটারের মতে, গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকটাই রাষ্ট্রনৈতিক নেতাদের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধের ওপর নির্ভরশীল । রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এসব গুণের ঘাটতি হলে গণতন্ত্র আদর্শভ্রষ্ট হয়। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা স্বার্থপর মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কুক্ষিগত হলে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রনেতাদের সততা, গুণগত যোগ্যতা ও কর্মতৎপরতার ওপর গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য একান্তভাবে নির্ভরশীল।

১১) শক্তিশালী বিরোধী দল

শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে। কিন্তু বিরোধী দল শক্তিশালী হলে সরকারের কাজের সমালোচনা করে এবং অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারকে সংযত হতে বাধ্য করে।

১২) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ

গণতন্ত্রে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব থাকে বিচার বিভাগের ওপর। একারণে বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হয়, অন্যথায় গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়।

১৩) সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত ব্যবস্থা

সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। জন স্টুয়ার্ট মিল এই যুক্তি সমর্থন করেন। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সরকার গঠিত হয়। এখানে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। ফলে জনগণের একটি অংশ সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ভাগ নিতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

১৪) জনমতের ভূমিকা

আধুনিক বিশ্বে জনমতকে গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি প্রধান শর্তরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকারি স্বৈরাচারিতাকে রোধ করতে সক্ষম হয় শক্তিশালী জনমত। জনমতকে সুসংহত করে তুলতে রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।

১৫) জাতীয় সংহতি ও ঐক্য

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জাতীয় সংহতি ও ঐক্য থাকা প্রয়োজন। মিলের মতে, জাতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে জরুরি। জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ না থাকলে গণতন্ত্র সাফল্যমন্ডিত হয় না। সামাজিক ঐক্যবোধের জন্য জাতিভেদ প্রথাসহ অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যের বিলুপ্তি প্রয়োজন।

১৬) রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের বাস্তব স্বীকৃতি

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য নাগরিকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলিকে শুধুমাত্র তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃতি দিলেই চলবে না, সেগুলিকে বাস্তবে কার্যকরী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চলাফেরার স্বাধীনতা, সংঘ বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ, জীবনের অধিকার, ধর্মের অধিকার ও সামাজিক সাম্যের অধিকার সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত থাকা দরকার।

১৭) সুনাগরিকতা

অনেকে জাতিগত, ধর্মগত এবং ভাষাগত সংকীর্ণতাকে গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে চিহ্নিত করেন। বলা হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি মানুষের সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সুনাগরিক হিসাবে জাতীয় কর্তব্য পালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতা, ধর্মান্ধতা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়, তাই গণতন্ত্রে নাগরিকদের এসব থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।

মূল্যায়ন

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য উপরিউক্ত শর্তগুলির উপস্থিতি প্রয়োজন। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে সফল করতে হলে শর্তগুলির উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকেও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রয়োজন হলে জীবনকে বিপন্ন করেও এগিয়ে যেতে হবে। তবেই গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে সফলতা পারে।

Leave a reply