Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

১৯২৭-৪৭ পর্যন্ত ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের বিবরণ দাও।

১৯২৭-৪৭ পর্যন্ত ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের বিবরণ দাও।

১৯২৭-৪৭ পর্যন্ত ভারতের শ্রমিক আন্দোলন

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভেই নির্যাতিত, শােষিত শ্রমিক শ্রেণি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শ্রমিক সংঘের সৃষ্টি করে। এর ফলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শ্রমিক আন্দোলনের ফলে যে শ্রেণি সচেতনতার অভাব ছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে তা ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত বিশ্বযুদ্ধ জনিত অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত রাশিয়ায় বলশেভিক আন্দোলনে শ্রমিকদের সাফল্য। তৃতীয়ত লক্ষ্ণৌ চুক্তি ও হােমরুল আন্দোলনে শ্রমিকদের মর্যাদা বৃদ্ধি। চতুর্থত শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস, নিরাপত্তার অভাব এবং সামাজিক মর্যাদা হানি। এই সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা সঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়ােজন অনুভব করে।

১৯১৮-১৯৪৭ খ্রীঃ ছিল শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও সংগ্রামের যুগ। ভারতবর্ষে প্রথম প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন বি.পি. ওয়াদিয়া। তাঁর গঠিত ট্রেড ইউনিয়নের নাম ‘মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন, (১৯১৮) এরপর ১৯২০ খ্রীঃ নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কারণ ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটি সংগঠনের আওতায় এল। যদিও ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের গতি ছিল মন্থর এবং আন্দোলন বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছিল।

১৯২৭ সালের পর ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলন একটি নিজস্ব জঙ্গী চরিত্র গ্রহণ করে। সাইমন কমিশন বিরােধী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। শ্রমিক আন্দোলনে এই সময় বামপন্থী ও সাম্যবাদী আদর্শ বিশেষ প্রসার লাভ করে। ১৯২৭ সালের ১লা মে বােম্বাইয়ে শ্রমিক দিবস পালিত হয়।

১৯২৮ সালের পর ভারতীয় শ্রমিক ধর্মঘট উত্তাল আকার ধারণ করে। এই বছর সারা দেশে অন্ততঃ ২০৩টি ধর্মঘট হয়। প্রায় ৫ লক্ষ ৫ হাজার শ্রমিক এই সকল ধর্মঘটে সামিল হয়। এই সময়কার সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় শ্রমিক আন্দোলন হল বােম্বাই-এর সুতাকল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক ছয়মাস ব্যাপী সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এই আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন কমিউনিস্ট পরিচালিত গিরণি কামাগড় ইউনিয়ন। এছাড়া দক্ষিণ ভারতীয় রেলপথ এবং মাদ্রাজ ও দক্ষিণ মহারাষ্ট্রে রেলপথের কর্মচারীরাও জঙ্গী আন্দোলনে নামেন।

শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি দেখে সরকারের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। সরকার দুইভাবে শ্রমিক আন্দোলন দমনে প্রয়াসী হলেন।

প্রথমত : আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারে হাত দিলেন। ১৯২৮ খ্রীঃ কেন্দ্রীয় আইনসভার শিল্প বিরােধ বিল’ ও ‘জন নিরাপত্তা আইনের সংশােধনী বিল’ দুটি উপস্থাপিত করা হয়। এই দুটি প্রস্তাবিত আইন দ্বারা শ্রমিক শ্রেণির স্বাধীন আচার আচরণের উপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করা হয়।

দ্বিতীয়তঃ শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতি অনুসরণ। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে মার্চ ভারতের বিভিন্ন অঞল থেকে ৩৩জন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতাকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে মুজাফ্ফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, পি. সি. যােশী, নলীনী গুপ্ত, ধরণী গােস্বামী প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। আর ছিলেন দুজন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট বেঞ্জামিন ব্রাডলে ও ফিলিপ প্যান্ট। গ্রেপ্তার করার পর এই সকল নেতাকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৩ খ্রীঃ পর্যন্ত মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলে এবং অধিকাংশ বন্দী দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘ কারাদন্ডে দন্ডিত হন।

এদিকে ১৯২৯ খ্রীঃ ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক ভাঙন দেখা যায়। এম. এন. যােশীর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থী গােষ্ঠী নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন।

ফেডারেশন নামে একটি পাল্টা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন। এই নতুন সংগঠনটি শ্রমিক শ্রেণির সবরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ বর্জন করে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণের স্বার্থে নিয়ােজিত থাকে। অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনের সর্বাধিক প্রগতিশীল গােষ্ঠীর অংশটি এই সময় বামপন্থী সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন থেকে বিরত থাকে। এইভাবে তিরিশের দশকের সূচনায় দমননীতি ও দলীয় মতবিরােধের ফলে শ্রমিক আন্দোলন বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৯৩৪ খ্রীঃ নাগাদ পুনরায় শ্রমিক আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। এইসময় ধর্মঘটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৯ এবং ধর্মঘটী শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষ ১০ হাজার ৮০৮। এই সময় কয়েকটি বড় রকমের ধর্মঘট দেখা দেয় সােলাপুর, নাগপুর ও বােম্বাইয়ের শ্রমিকদের মধ্যে। শ্রমিক ধর্মঘটে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারী কর্তৃপক্ষ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ১৯৪৩ খ্রীঃ ২৩শে জুলাই কমিউনিস্ট দল সরকারীভাবে বে-আইনী ঘােষিত হল। কিন্তু বে-আইনী হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিস্ট দলের প্রভাব হ্রাস পায় নি।

১৯৩৬ খ্রীঃ পর ভারতের শ্রমিক আন্দোলন আরাে সুদৃঢ় হয়ে উঠতে থাকে। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি পেল এবং কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রভৃতির সঙ্গে যৌথভাবে শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নিতে লাগল। ১৯৩৮ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে ভারতের দুটি প্রধান শ্রমিক সংস্থা ভারতীয়। ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের মধ্যে সংহতি সাধন হয়। এদিকে ১৯৩৭ খ্রীঃ আটটি প্রদেশে কংগ্রেস দল ক্ষমতাশীল হওয়ায় শ্রমিক সংগঠন দিন দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৩৬-৩৯ এই তিন বৎসর নথিভুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইসময় ভারতের বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত হয়। এগুলির মধ্যে কানপুরের সূতীবস্ত্র শিল্পে ধর্মঘট, আসামের ডিগবয়ে শ্রমিক ধর্মঘট প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। দুঃখের বিষয় প্রাদেশিক কংগ্রেসী মন্ত্রিসভাগুলি শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতিতে অস্বস্তি বােধ করতে লাগলেন। ১৯৩৮ খ্রীঃ নভেম্বরে বােম্বাই সরকার শিল্প বিরােধ আইন চালু করে। শ্রমিক আন্দোলন দমনে অগ্রসর হলেন। এর ফলে সমস্ত ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং বােম্বাইয়ে হরতাল পালিত হয়। ১৯৩৯ খ্রীঃ ২রা অক্টোবর বােম্বাইয়ে ৯০ হাজার শ্রমিক যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করেন। এদিকে যুদ্ধের ফলে ভারতের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিল এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পেল। মহার্ঘ ভাতার দাবীতে শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনের পথে অগ্রসর হলেন। ১৯৫০ সালের ৫ই মার্চ বােম্বাইয়ের ১ লক্ষ ৭৫ হাজার সুতাকল শ্রমিক মহার্ঘ ভাতার দাবীতে সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হন। এরপর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকগণও মহার্ঘ ভাতা ও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে যােগ দেন। এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্টদের প্রভাবে শ্রমিক আন্দোলন অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করতে সমর্থ হয় এবং ক্রমশঃ জঙ্গী রূপ ধারণ করে।

১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির বিরােধিতা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণিকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয় নি। ৯ই আগস্ট গান্ধীজী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বােম্বাই, নাগপুর, জামসেদপুর প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরা এক সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট পালন করে। এর মধ্যে আমেদাবাদ বস্ত্র কলগুলিতে ধর্মঘট চলে প্রায় তিন মাস।

১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ খ্রীঃ শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার আসে। আজাদ হিন্দ সৈনিকদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে সামিল হয়। ১৯৪৫-এর শেষদিকে বােম্বাই ও কলকাতা বন্দরে শ্রমিকরা ইন্দোনেশিয়া-গামী জাহাজে মাল বােঝাই করতে অস্বীকার করে, কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাতীয় মুক্তি আন্দোলন দমনে নিযুক্ত সেনাদলের রসদ ও অস্ত্রাদি ঐসব জাহাজে করে পাঠানাে হচ্ছিল। ১৯৪৬ খ্রীঃ ২২শে ফেব্রুয়ারী বােম্বাইয়ের প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক নৌসেনা বিদ্রোহীদের সমর্থনে ধর্মঘট করে। ঐ বছরেরই জুলাই মাসে সারা ভারত ডাক ও তার কর্মীদের ধর্মঘটেও শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। সুতরাং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনেও শ্রমিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

Download PDF

Please wait..
If the download didn’t start automatically, click here.

Leave a reply