Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

কনফুসিয়াস কে? কনফুসিয়াসের মতাদর্শ আলোচনা কর।

চিনা ঐতিহ্যে তথা চিনা সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাসে কনফুসীয়পন্থার প্রভাব অপরিসীম। কনফুসীয়পন্থার প্রবক্তা ছিলেন কনফুসিয়াস। ফেয়ারব্যাঙ্ক লিখেছেন— কনফুসিয়াস ছিলেন চিনের প্রথম পেশাদার শিক্ষক ও দার্শনিক এবং আজও তিনি পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও দার্শনিক হিসাবে স্বীকৃত। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চিনা সমাজের ধারকের ভূমিকা পালন করেছিল কনফুসিয়াসের মতাদর্শ। একথা অনস্বীকার্য যে, চিনের দাস সমাজে এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শাসকশ্রেণীর স্বার্থ চরিতার্থ করেছিল কনফুসিয়াসের দর্শন। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও সত্যি যে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে অন্য কোনো মতাদর্শ এতদীর্ঘকাল ধরে এত বড়ো একটা দেশের রাষ্ট্রনীতি ও সমাজজীবনকে এত গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। ফেয়ারব্যাঙ্ক মনে করেন— মাসকবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী বিশ শতকের চিনা কমিউনিস্টরাও কনফুসীয়পন্থার দ্বারা প্রভাবিত চিনে ভাবগত অতীতকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারেননি।

চৌ রাজত্বে ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কনফুসিয়াসের জন্ম। তাঁর জীবনকাল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ থেকে ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের কিছু আগে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। কনফুসিয়াস কথাটি ছিল চীনা কুং-ফু-জু এর ল্যাটিন সংস্করণ । চিনা জু শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Master। কনফুসিয়াস, তাঁর মতাদর্শ ও তার দর্শন সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ‘লুন-উ’ বা ‘বচনসংগ্রহ’ (Analects) থেকে। লুন-উ বা Analects কতগুলি প্রশ্নের উত্তর। শিষ্য প্রশ্ন করেছেন, গুরু কনফুসিয়াস তার উত্তর দিয়েছেন। ‘বচন সংগ্রহ’ বা লুন-উর সংকলক কনফুসিয়াসের কোনো শিষ্য বা শিষ্যের শিষ্য। কনফুসিয়াস এমন এক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন। যার প্রভাব মহাকাল খর্ব করতে পারেনি। কিন্তু তাঁর লিখিত একটি মাত্র বই এর কথা জানা যায় – লু রাজ্যের ইতিবৃত্ত (Annals of the State of Lu)। তবে তাঁর মতবাদ ও দর্শন সম্পর্কে জানার জন্য লুন-উ বা Analects ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান।

১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে কনফুসিয়াস সম্পর্কে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির নাম – The Morals of Confucius : A Chinese Philosopher। ইংরেজিতে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি ফরাসি থেকে, আবার ফরাসি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি ল্যাটিন থেকে অনূদিত। কিন্তু মূল চীনা গ্রন্থের কোনো হদিশ ঐতিহাসিকরা পাননি। ইংরেজি গ্রন্থটিতে কনফুসিয়াসের জীবনী, তাঁর জীবন দর্শন ও দার্শনিক চিন্তাভাবনা বিবৃত হয়েছে। একই সঙ্গে সংকলিত হয়েছে তাঁর ৮০ টি শিক্ষামূলক বাণী। এটি কনফুসিয়াসের ওপর ইংরেজিতে লেখা প্রথম গ্রন্থ। গ্রন্থকার ভূমিকায় কনফুসীয় দর্শন প্রসঙ্গে লিখেছেন— অসীম মহিমান্বিত, কিন্তু একই সঙ্গে বিচক্ষণ, যে বিচক্ষণতা নিখাদ মানবিক যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত।

কনফুসিয়াস ছিলেন ঐতিহ্যশালী লু মধ্য রাজ্যের অধিবাসী। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীপদে নিযুক্ত হবার উগ্র বাসনা তাঁর ছিল। এই ধরনের পদলাভের আকাঙ্ক্ষায় তিনি বিভিন্ন রাজ্যে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁকে গ্রহণ করেননি। একজন বস্তুনিষ্ঠ রাজনীতিবিদের জীবন ছিল তাঁর কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত । কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হন। তখন নিরুপায় হয়ে বেছে নেন শিক্ষকের পেশা। মহাকাল প্রমাণ করল যে, এই পেশায় তিনি সাফল্যের শীর্ষে উন্নীত হলেন।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে মনে হতে পারে কনফুসিয়াসের দর্শন বৈচিত্র্যহীন। সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যাগুলির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আদৌ নিরপেক্ষ ছিল না। আত্মা, স্ব ইত্যাদি বিষয়গুলি তাঁর বক্তব্যে বহুবারই ঘুরে ফিরে এসেছে। অনেকসময় এরকম ধারণাও তিনি দিয়েছেন, স্বর্গীয় নির্দেশ তাঁর উদ্দেশ্য নির্ধারিত করে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ও মতাদর্শ একটু মনযোগ সহকারে অনুধাবন করলে স্পষ্টই বোঝা যায় আধিভৌতিক বা অতিমানবিক বিষয়ে তাঁর তেমন উৎসাহ ছিল না। তাঁর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মর্ত্যের সমস্যাবলী। একবার তাঁর এক শিষ্য প্রশ্ন করেছিলেন— মৃত্যু কী? এর উত্তরে কনফুসিয়াস বলেছিলেন— “জীবন কী তাই বঝলে না, মৃত্যু উপলব্ধি করবে কী করে?” রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও তিনি দাবি করেছিলেন, যে, তিনি প্রাচীনত্ব ও অতীতের এক একনিষ্ঠ ছাত্র। অতীত থেকে অর্জিত জ্ঞান তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করতে চান। তিনি মনে করতেন, তাঁর সমকালীন বিশৃঙ্খলা ও ভ্রান্তি তখনই শুধরে নেওয়া সম্ভব, যখন চীনের মানুষ চৌ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ওয়েন ও চৌ এর ডিউক প্রবর্তিত রজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলি ফিরিয়ে আনবে।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন সমাজে প্রতিটি মানুষের জন্য একটি ভূমিকা নির্দিষ্ট করা আছে। প্রতিটি মানুষেরই সেই নির্দিষ্ট ভূমিকা যথাযথ ও আন্তরিকভাবে পালন করা উচিত। এ প্রসঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য – একজন শাসক হবেন, প্রজা হবেন প্রজা। পিতা পিতার মতো আচরণ করবেন, পুত্রের আচরণ হবে পুত্রবৎ। কনফুসিয়াস জোরের সঙ্গে বলেছিলেন— এই নীতি হবে সমাজের ভিত্তি।

উপরোক্ত বক্তব্যের জন্য কনফুসিয়াসের দর্শনকে অতিরিক্ত মাত্রায় রক্ষণশীল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, নীতিজ্ঞান সুশাসনের মূল ভিত্তি এই মৌলিক ধারণার মহান প্রবক্তা ছিলেন কনফুসিয়াস। একথা সত্যি যে, তিনি প্রভুদের শাসন করার বংশানুক্রমিক অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু একথা বলতে তিনি ভোলেননি যে, তাঁর শাসক হিসাবে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে অন্যায় বলপ্রয়োগ যে সময় চীনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, ক্ষমতাশালীর দম্ভ যখন সাধারণ চীনাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল, সে সময় কনফুসিয়াস ঘোষণা করেন শক্তির অপপ্রয়োগ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উপায় নয়। শাসকের গুণাবলী এবং শাসিত জনসাধারণের পরিতৃপ্তি রাজনৈনিক সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি। স্বর্গের আদেশ অনুযায়ী একজন শাসক ততদিনই শাসন করার অধিকারী যতদিন তিনি সুশাসনের মাধ্যমে প্রজাদের পরিতৃপ্ত রাখতে পারবেন।

কনফুসীয় মতাদর্শে অত্যাচার বিরোধের অনুমোদন নেই। যুক্তি প্রয়োগ করে মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। খুব সম্ভবত সে কারণেই চীনা ঐতিহ্যে একজন মহান পণ্ডিতেরা মর্যাদা একজন সফল সৈন্যাধ্যক্ষের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ শতকের প্রখ্যাত শান্তিবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল তাই লিখেছিলেন— পাশ্চাত্যের দেশপ্রেমের চেয়ে কনফুসীয় মতাদর্শে প্রতিফলিত শান্ত, সহনশীল ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কনফুসীয় মতাদর্শ জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশপ্রেম সংক্রান্ত ধারণা সাম্রাজ্যবাদ ও সমরবাদ এর জন্ম দিয়েছে কনফুসিয়াস ছিলেন চীনের প্রথম নীতিবাদী। তিনি এমন এক প্রাচীন সভ্যতার নৈতিক ঐতিহ্যের অগ্রদূত ছিলেন, যে সভ্যতা নৈতিক মূল্যবোধকে সবকিছুর ওপর স্থান দিয়েছিল।

কনফুসিয়াসের মতাদর্শ তাঁর সময় থেকে চ্যুই ধর্ম নামে পরিচিতছিল। প্রাচীন চীনা সভ্যতায় একজন চ্যুই ছিলেন রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি, যার দেশ ও বিশ্বের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। চ্যুই ধর্মের ব্যাখা দিতে গিয়ে কনফুসিয়াস বলেছেন – একজন চ্যুই হবেন উদারমনোভাবাপন্ন, ক্ষমতাসীন মানুষের অনুগ্রহের প্রতি লালায়িত হবেন না তিনি, সাফল্য বা অসাফল্য কোনো কিছুতেই সত্যের পথ বর্জন করবেন না তিনি এবং একই সঙ্গে তিনি অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং নিয়মনীতি সম্পর্কে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করবেন। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কনফুসিয়াসের বক্তব্যে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে।

একথা অস্বীকার করা যায় না যে, কনফুসিয়াস প্রচারিত দর্শনের মধ্যে এমন একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সমসাময়িক সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা । সামাজিক ক্রমবিন্যাস ও শ্রেণী বিভাজনকে অনুমোদন দিয়েই তিনি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি রূপরেখা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র শাসকের শক্তির ওপর ভিত্তি করে সামন্তশ্রেণীর স্বার্থবাহী রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেননি তিনি। শাসকের পুণ্য (Virtue) এবং প্রজাদের পরিতৃপ্তির (Contentment) মধ্যে তিনি সমন্বয় বিধান করতে চেয়েছিলেন।

জোসেফ নিডহ্যাম লিখেছেন – কনফুসিয়াস এই গণতান্ত্রিক ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন যে শাসকের ক্ষমতার প্রাথমিক উৎস হল জনগণের ইচ্ছা বা স্বর্গীয় আদেশেরই প্রতিফলন। নিডহ্যাম মনে করেন, “ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইউরোপের ধর্মতত্ত্ববিদেরা যে অ-খ্রিস্টীয় শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা ভেবেছিলেন, তা দু’হাজার বছর আগেই বলে গিয়েছিলেন কনফুসিয়াস ও তাঁর শিষ্যরা”।

নিডহ্যাম একই সঙ্গে বলেছেন – প্রচলিত ব্যবস্থা তথা স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই অবশ্য কনফুসিয়াস এই গণতান্ত্রিক ধারণা প্রচার করেছিলেন। বস্তুত কনফুসীয় মতাদর্শে এত নানাবিধ  উপাদানের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়েছিল যে, সামন্ততান্ত্রিক শোষণ নির্ভর সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ের শাসকেরা বিভিন্নভাবে এই মতাদর্শকে রাষ্ট্রশাসনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। প্রজার ইচ্ছার প্রতি শাসককে আন্তরিক থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি রাজদণ্ডকে স্থায়ী ও দৃঢ় করতে চেয়েছিলেন।

প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, যে অর্থে কনফুসীয়পন্থা কোনো ধর্ম ছিল না। তাঁর বাণীতে স্বর্গ-নরক, দেবতা, ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি কোনোকিছুর উল্লেখ নেই। এমনকি মানুষকে তিনি দেবতার স্তরে উন্নীত করার কথাও বলেননি। তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ হবার কথা বলেছিলেন। পরোপকারী ব্যক্তি, অনুগত শ্রদ্ধাশীল পুত্র, প্রীতিময় ভ্রাতা – এরাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। এরাই হয়ে উঠবেন সত্যিকারের ভালো নাগরিক। ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে জীবনে অগ্রসর হওয়ার দর্শন প্রচার করেছিলেন তিনি। বিরোধহীন নির্বিবাদী একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরির ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সে কারণেই চীনের মানুষের কাছে, বিশেষত শাসকশ্রেণীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অসামান্য শিক্ষক ও কালজয়ী দার্শনিক।

Leave a reply